কৃষ্ণকুমার দাস: বারাকপুর চিড়িয়ামোড়ের অনামিকা পাত্র। বয়স ২৪, প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি এমএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। টানা ৩২ দিন আক্কেল দাঁত ওঠার অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছেন।
খাওয়ার পরেই বাঁদিকের নিচের মাড়ির দাঁতের গর্তে খাদ্যকণা ঢুকে পড়ায় ‘ভয়ংকর যন্ত্রণা’ হচ্ছে মাসখানেক ধরেই। ঘন ঘন লবঙ্গ-নুন জলেও কাজ হচ্ছে না বেহালার সরকারি কর্মী দেবজ্যোতি পাত্রর।
দীর্ঘদিন পান-মশলা খাওয়ায় মুখের ভিতরে, দাঁতের পাশে আলসার হওয়ায় রাতে ঘুমাতে পারছেন না শান্তিনিকতনের প্রবীণ শিক্ষিকা সুমিতা সাহা। যন্ত্রণায় রাতভর ছাদে পায়চারিতে উপশম খুঁজে ফিরছেন।
অনামিকা, দেবজ্যোতি ও সুমিতার মতো হাজার হাজার রোগী লকডাউনে দাঁতের ডাক্তার না পেয়ে মাসখানেক ধরে অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন। কারণ, মানুষের শরীরে করোনার গর্ভগৃহ মুখের ভিতরের লালাগ্রন্থি, তাই দাঁতের চিকিৎসায় সর্বাধিক ঝুঁকি থাকায় রোগীই দেখছেন না রাজ্যের অধিকাংশ দন্ত চিকিৎসক। নথিভুক্ত ডেন্টাল সার্জন রাজ্যে প্রায় ছয় হাজার হলেও তিন সরকারি ডেন্টাল কলেজে গুটিকয় ডাক্তার শুধুমাত্র দুর্ঘটনায় জখম রোগীদের চিকিৎসা করছেন। যদিও সরকারি ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা ৭০০। এর মূল কারণ, সরকারি ডেন্টাল সার্জনরাও শুক্রবার পর্যন্ত পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ক হাতে পাননি। বস্তুত এই কারণেই আউটডোর বন্ধ থাকলেও জরুরি পরিষেবা নিয়ে আপাতত ‘টিম টিম’ করে চলছে কলকাতার আর আহমেদ, বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ ডেন্টাল কলেজ। বর্ধমান ডেন্টাল কলেজের এক সার্জন করোনা আক্রান্ত হয়ে সঞ্জীবন হাসপাতালে ভরতি হওয়ায় ১৩ সহকর্মীও কোয়ারান্টাইনে। PPE ও মাস্ক না পাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আর আহমেদের অধ্যক্ষ ডাঃ তপন গিরি দায়সারা উত্তরে জানান, “সরকারি নিয়ম মেনে সব চলছে।”
দাঁতের যন্ত্রণা-অসুখের পাশাপাশি নাক-কান-গলা ও চোখের ডাক্তাররা যেহেতু রোগীর মুখের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করেন তাই কোভিড-১৯ (COVID-19) সংক্রমণের ভয়ে চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের ভয়ে দন্ত চিকিৎসকরা হাত তুলে নেওয়ায় দাঁতে গর্ত হওয়া রোগীদের রুট ক্যানেল বন্ধ হওয়ায় লকডাউনে চরম দুর্ভোগে কয়েক হাজার রোগী। তামাকজাতীয় পণ্য ব্যবহারে মুখের আলসার (ক্যানসারে প্রথম ধাপ, মাড়ি ফুলে যাওয়া, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, দাঁতের নিচে বা মাড়িতে টিউমার হওয়ার ঘটনায় কষ্ট পাওয়া রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। কিন্তু মুখের কাছে নিজের চোখ রেখে চিকিৎসা করার ঝুঁকি নিচ্ছেন না অধিকাংশ ডেন্টাল সার্জন। আর আহমেদের ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসক জানান, “করোনার জীবাণু শরীরে ঢুকে তো গলায় ও লালাগ্রন্থিতে বাসা বাঁধে। মুখে দাঁতের চিকিৎসা করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে লালা বেরিয়ে আসবে। যদি রোগীর শরীরে কোভিড-১৯ (COVID-19) ঢুকে পড়ে আর তাঁর দাঁতের চিকিৎসা করতে গেলেই তো ওই ডাক্তারও সংক্রমিত হবেন।” মূলত এই ভয় থেকেই যে অধিকাংশ ডেন্টাল সার্জন চেম্বারে রোগী দেখছেন না তা স্বীকার করেছেন ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক ডাঃ রাজু বিশ্বাস।
একইভাবে করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে রাজ্যের অধিকাংশ নাক-কান-গলার ডাক্তাররাও রোগী দেখছেন না। পিজি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ অরুণাভ সেনগুপ্ত জানান, “রোগীর গলা বা নাক পরীক্ষা না করে কোনও রোগী দেখা সম্ভব নয়। আরও এই দুটো অঙ্গই হল মানুষের শরীরে করোনার হেডকোয়ার্টার।” প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে গেলে পিপিই ও এন—৯৫ মাস্ক মিলিয়ে দাম প্রায় দেড় হাজার টাকা। কিন্তু একজন সাধারণ ডেন্টাল সার্জনের ভিজিট মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তাই আর্থিক ক্ষতি করে পিপিই কিনে রোগী দেখতে চাইছেন না কোনও ডেন্টাল সার্জনই। চিকিৎসকদের তরফে ডাঃ বিশ্বাস বলেন, “একবার যদি কোনও ডেন্টিস্টের চেম্বারে করোনা রোগী ধরা পড়ে তবে এক বছর কেউই আসবেন না। এমন ঝুঁকি নিয়ে কেউ চেম্বারে রোগী দেখছেন না।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.