Advertisement
Advertisement

Breaking News

‘চালককে কান থেকে ফোন সরাতে বলেছিলাম, একবার যদি কথাটা শুনত!’

দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদে মোড়া এমন অন্ধকার দিন আর আসেনি দৌলতাবাদে।

Daulatabad Bus Tragedy: Survivours recall horrific moment driver lost control
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:January 29, 2018 1:50 pm
  • Updated:January 30, 2018 8:34 am  

অতুলচন্দ্র নাগ:  ভয়ে এখনও গলা বুঝে আছে সাধন মণ্ডলের। ভাল করে কথা বলতে পারছেন না। থেকে থেকে কেঁপে উঠছেন। আর বিড়বিড় করে বলে চলেছেন, কতবার কান থেকে ফোন সরাতে বলেছিলাম। আমার কথা যদি একটাবার শুনত! বেঁচে যে আছেন তাই-ই যেন অলৌকিক। এখনও তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না ডোমকলের সাজেদা বিবি। বাসটা যখন খালে পড়ছে তখন দরজা থেকে শরীরটা ছিটকে গিয়েছিল। কনকনে ঠান্ডা জলের ভিতর পড়ে শুধু একটা আলোর রেখা দেখতে পেয়েছিলেন। বাঁচার জন্য তা লক্ষ্য করেই কোনক্রমে হাত-পা ছুঁড়ছিলেন। আর বিশেষ কিছু মনে করতে পারছেন না। ঠান্ডা জলের মতো মৃত্যুভয় সারা শরীর গ্রাস করেছিল আফরিনেরও। জানালা দিয়ে নিজেকে বাইরে ছুড়ে দিয়েছিলেন। তারপর কোনওক্রমে সাঁতরে পাড়ে উঠেছেন। পিছনে তখন মৃত্যুমিছিল। অসংখ্য মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার, বাঁচার কাতর আর্তি।

মৃতদের পরিবার পিছু ৫ লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদানের ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর ]

Advertisement

কী থেকে যে কী হয়ে গেল এখনও ভেবে উঠতে পারছে গোটা দৌলাতাবাদ। গোটা জেলায় মৃত্যুর বিষাদ ছায়া। বিলের পাড়ে অপেক্ষা করে আছেন হাজার হাজার মানুষ। মেয়েটা আর কি বেঁচে ফিরবে? ওই গভীর জলের তলায় ছেলেটা কি এখনও বেঁচে আছে? বুকভাঙা আর্তনাদে খানখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে প্রশ্নগুলো। এনডিআরএফ-এর কর্মীরা এসেছেন। বহু চেষ্টায় একটা করে মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে, আর চাপা কান্নার রোল উঠছে ইতিউতি। গোটা দৌলতাবাদ যেন একদিনের জন্য কান্না আর আর্তনাদের শহর হয়ে উঠেছে।

ঘুমের ‘কোটা’ পূর্ণ হয়নি চালকের, চার ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল ট্রেন ]

সামান্য একটা ভুল। একগুঁয়েমি। আর তার জন্যই মুহূর্তে লাশ হয়ে উঠল ৩৫টিরও বেশি জলজ্যান্ত মানুষ। বহরমপুরের দিকে যাঁরা যাচ্ছিলেন, তাঁরা কে জানতেন, নিয়তিতে লেখা আছে সলিলসমাধি! ভয় অবশ্য পেয়েছিলেন বার নদিয়ার এক বাসিন্দাও। বছর পঞ্চাশের বৃদ্ধ উঠেছিলনে করিমপুর থেকে। বসেছিলেন চালকের পিছনেই। কানে ফোন নিয়েই এক হাতে স্টিয়ারিংয়ে রেখে বাস চালাচ্ছিলেন চালক। ভয় পেয়ে চালককে সাবধান করেন প্রৌঢ়। উলটে ধমক খেয়ে চুপ করে যান। এখন ভাবছেন, তখন যদি একটু গলা তুলে কথা বলতেন তাহলে এই কালো দিন দেখতে হত না। একই কথা সাধন মণ্ডলেরও। বলছেন, “আমি তো ওই ড্রাইভারের পিছনের সিটেই বসেছিলাম। ফোনে কারও সঙ্গে একেবারে হাসি ঠাট্টায় মশগুল হয়ে পড়েছিল। সেটাই যে কাল হবে বুঝতে পারিনি। শুনছি অনেকে বলছেন, কুয়াশার জন্য নাকি এই দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি তো সামনের রাস্তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। কুয়াশা ছিল না। তবে রাস্তাটায় খুব বাঁক ছিল। একহাতে বাঁকগুলিতে ওভাবে গাড়ি চালানো দেখে আমার ভয় ধরে গিয়েছিল। বাকি বেশিরভাগ যাত্রীই জানালা বন্ধ করে ঝিমোচ্ছিলেন। কেউ আবার হেডফোনে গান শুনছিলেন। শীতের সকালে যা হয় আর কী! দৌলতাবাদের বালিঘাট সেতুতে বাস ওঠার আগে থেকেই পাশ দিয়ে একটা ট্রাক সেতুতে এসে পড়ল। তখনও মোবাইল কানে কথা বলতে বলতেই ট্রাককে ওভারটেক করার চেষ্টা করল ড্রাইভার। খুব সামনে থেকে দেখলাম বাসটি আচমকা ডানদিকে বেঁকে সেতুর রেলিংয়ের ধারে চলে এল। হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ। বাসটা তখন যেন শূন্যে উড়ছে। মুহূর্তেই জলের মধ্যে পড়ে যায় বীভৎস শব্দে।”

ওই শেষ। চালকের ফোনে কথা বলাই কাল হল। ঝিমোতে ঝিমোতেই চেঁচামেচি শুনে অনেকের চমক ভাঙল। তখন সেতুর উপর থেকে বাস পড়ছে নিচে। জানালা দিয়ে তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ।  কিন্তু মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যাত্রীদের কেউ কেউ। জানলা দিয়ে কেউ ঝাঁপ দেন জলে। পড়েন গিয়ে বিলের ঠান্ডা জলে। সেখান থেকেই কোনওক্রমে সাঁতরে-হাতড়ে বেঁচে ফেরেন। কনকনে ঠান্ডা জলের থেকেও তখন হিমশীতল মৃত্যুভয় নেমে যাচ্ছে শিরদাঁড়া বেয়ে। উপরে তখন আলো নিয়ে এসে জমায়েত হয়েছেন স্থানীয় মানুষরা। জলের গভীরে হাওয়ার অভাবে খাবি খেতে খেতে চোখে পড়ছিল শুধু ওই আলোটুকুই। তা লক্ষ্য করেই উঠে আসতে থাকেন সাঁতার জানা যাত্রীরা।  সকলেই জানাচ্ছেন, তখন কেউ টেনে ধরছে পা। কেউবা হাত। সকলেই একে অপরকে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন। বদলে হয়তো সকলেই তলিয়ে গিয়েছেন। আর কোনওক্রমে যাঁরা প্রাণ পেয়েছেন, তাঁরা এখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে বেঁচে আছেন। কেউ বলছেন ভগবানের আশীর্বাদ। কেউ বলছেন আল্লার দোয়া। নিজেদের প্রাণ তো বাঁচল। কিন্তু কীসের জন্য অন্যের ভুলের মাশুলে প্রাণ গেল এতজনের? উত্তর পাচ্ছেন না কেউই। মা ফিরেছে, ফেরেনি স্বামী-ছেলে। মেয়ে ফিরেছে, বাবা ফেরেনি। যত সময় গড়িয়েছে না ফেরার সংখ্যা তত বেড়েছে। ক্রমে ক্রমে বিধ্বস্ত মানুষ বুঝেছেন আর ফিরবেন না অনেকেই। মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে।

বাস দুর্ঘটনায় রণক্ষেত্র দৌলতাবাদ, পরিস্থিতি মোকাবিলায় শূন্যে গুলি পুলিশের ]

মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন। সামনে থেকে তদারক করছেন উদ্ধারকার্যে। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের একটাই কথা, মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা বলবেন, যে চালকরা কানে ফোন নিয়ে গাড়ি চালান, যাঁদের জন্য এমন দুর্ঘটনা ঘটে, তাঁদের জন্য যেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন তিনি। হয়তো তা করবেনও তিনি। কিন্তু তাতে কী আর ফিরবে চলে যাওয়া মানুষগুলো? জলের তলায় পাঁকের গভীরে আটকে দমবন্ধ হয়ে যে দুটি শিশু চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ল তাদের কি আর জাগানো যাবে? আর কী ফিরবে ভোরে আবছা আলো অন্ধকার হয়ে যাওয়া সেই মুহূর্তটা। যে মুহূর্তটা ফিরিয়ে নিতে পারলে বেঁচে যেত এতগুলো মানুষ। কান্না আর আর্তনাদ বুকে চাপতে চাপতে গোটা দৌলতাবাদ যেন ক্রমে বুঝছে, এত অন্ধকার সকাল আর আসেনি কখনও।

ছবি: সাবির জামান

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement