ছবি: প্রতীকী
প্রীতিকা দত্ত: টেস্টিং, ট্রেসিং, আইসোলেশন। সোজা বাংলায়- পরীক্ষা, রোগনির্ণয়, পৃথকীকরণ। নোভেল করোনা ভাইরাসকে হারাতে এই তিন ধাপই আপাতত হাতিয়ার পশ্চিমবঙ্গের। কেরলে ‘বন্ধু ক্লিনিক’ তৈরি করে করোনা সংক্রমণকে লাগাম দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিছুটা সাফল্যও এসেছে। তামিলনাড়ুতেও সম্প্রতি চালু হয়েছে কোভিড-১৯ চিহ্নিতকরণের মোবাইল টেস্টিং ভ্যান। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, যত বেশি টেস্ট, তত কম করোনার সংক্রমণ। তাই র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট ছাড়া এখন উপায় নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আশার কথা, সেই পথেই এগোচ্ছে বাংলা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের নির্দেশিকাতে জানানো হয়েছে, করোনা উপসর্গ না থাকলেও কোভিড টেস্ট হবে। লালারসের নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে। হটস্পট বা স্পর্শকাতর এলাকায় লালারসের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য। কারণ, ‘অ্যাসিম্পটোমেটিক’ কোভিড রোগীই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজ্য সরকারের করোনা মোকাবিলা কমিটির সদস্য বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানালেন, এরাজ্যে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু হয়েছে। এই টেস্ট নিয়ে তিনি বলেন, “এ রাজ্যে (মাইক্রো প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে) সংক্রমিত জায়গা বেছে এই টেস্ট শুরু হয়েছে। এসএসকেএম, স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মতো কিছু হাসপাতাল এবং বেসরকারি প্যাথল্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ এগোচ্ছে।”
গত মার্চে দেশে নোভেল করোনাভাইরাস টেস্ট করা হত শুধু বিদেশ ফেরতদের ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের। পরে দেখা যায়, বিদেশযোগ নেই, এমন মানুষজনও করোনায় সংক্রামিত হচ্ছেন। ফলে করোনা উপসর্গ দেখলেই টেস্ট করানোর নির্দেশ জারি হয়। করোনা হয়েছে কি না জানতে, সারা দেশে রিয়েল টাইম পলিমেরিস চেন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর) টেস্টের চল রয়েছে। কিন্তু এই টেস্টে যেমন সময় লাগে, তেমন খরচও বেশি। তাই করোনা ঠেকাতে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এদেশেও র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
সম্প্রতি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-ও করোনা নির্ণয়ের এই পদ্ধতিতে সিলমোহর দিয়েছে। র্যাপিড অ্যান্টিবডি ব্যাপারটা ঠিক কী? মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. দীপনারায়ণ মুখোপাধ্যায় জানালেন, আঙুলে সুচ ফুটিয়ে দু’-এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। অনেকে একে ‘কার্ড টেস্ট’ও বলেন। সংগৃহীত রক্তের নমুনা কিছুক্ষণ রাখলে সিরাম আলাদা হয়ে যায়। সিরামে কোভিডের আইজিএম বা আইজিজি রয়েছে কি না, তা যাচাই করে নিলেই র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট সম্পূর্ণ হয়। সংক্রমিত এলাকায় জনঘনত্ব বেশি হলে যার ফল মেলে হাতেনাতে। “র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের সবচেয়ে বড় ইউএসপি, এতে সময় লাগে সাকুল্যে তিরিশ মিনিটের মতো। রিপোর্ট পজিটিভ এলে স্যাম্পল আরটি-পিসিআর টেস্টের জন্য পাঠানো হয়। তবে এখানে এ-ও জেনে রাখা দরকার যে, রক্তে কোভিডের অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ-সাতদিন লেগে যায়।”
অন্যদিকে আরটি-পিসিআর টেস্ট প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: এতে নাক ও মুখের সোয়াব নেওয়ার জন্য দরকার উপযুক্ত পিপিই কিট। এবং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী। এর রিপোর্ট আসতে আট থেকে বারো ঘণ্টার মতো সময় লাগে। তাতে রোগ জটিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বাড়ে। উপরন্তু আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট বিদেশ থেকে আনাতে হয়। বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। তাই র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের মতো ‘স্ক্রিনিং টেস্ট’ এদেশে দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সারা দেশের ১৭০ জেলাকে ‘কোভিড হটস্পট’ তকমা দিয়েছে। ২০৭ জেলাটি জেলাকে সম্ভাব্য হটস্পট হিসাবে চিহ্নিত প্রসঙ্গত, যে এলাকায় একাধিক কোভিড পজিটিভ রোগীর সন্ধান মিলিছে, সেগুলোই কোভিড হটস্পট। সবার আগে দেশের ১৭০ হটস্পটে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রের খবর।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ সোশ্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ-এর গবেষক অমিতাভ সরকারও র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের পক্ষে সওয়াল করছেন। “জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলতেই পারি, র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের উদ্যোগ ইতিবাচক। কারণ, ভারতের মতো জনবহুল দেশে কোভিড আক্রমণের মুখে এটাই ঢাল হিসেবে কাজ করবে। কোনও হটস্পটে পাঁচ লক্ষ মানুষের বাস হলে সেখানে আরটি-পিসিআর টেস্ট কার্যত অচল।”- মন্তব্য অমিতাভবাবুর। তাঁর যুক্তি, “সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াও প্রাথমিকভাবে র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের উপর ভরসা রেখেছিল। যে কারণে ওই সব দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার- দু’টোই তুলনায় কম।” তবে শুধু টেস্ট সেন্টার নয়। পরীক্ষাকেন্দ্র ছাড়াও র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্টের সাফল্যের জন্য যে উপযুক্ত কিয়স্ক ও মোবাইল ভ্যান দরকার, তা-ও বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন অমিতাভবাবু। “সেটা করতে পারলেই সংক্রমণ রোখা যাবে,” বলছেন তিনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.