সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো, কাটোয়া ও কালনা: গ্রামের ছেলের নিথর দেহ ঘরে ফিরল। চাঁদা তুলে গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে ঘরে ফেরালেন গ্রামবাসীরাই। ট্রেন দুর্ঘটনায় (Coromandel Express Accident) মৃত্যুপুরী থেকে দেহ বাড়িতে আনতে গিয়ে অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবার। মৃতদেহ বা আহতদের বাড়িতে ফেরাতে কোনও ব্যবস্থা করেনি রেল। দ্বিগুণ গাড়িভাড়া দিয়ে দেহ আনতে হচ্ছে। চাঁদা তুলে গ্রামবাসীরা পূর্বস্থলীর অসহায় এক পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার কাটোয়ার এক শ্রমিক পরিবার গয়না বন্ধক রেখে মৃতদেহ বাড়িতে এনেছে।
বাড়িতে দেহ ফিরিয়ে আনতে রেল কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করলেও সহযোগিতা মেলেনি। বাধ্য হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে গ্রামের বাড়িতে আনতে হয়েছে মৃতদেহ। রবিবার পূর্বস্থলীর নিমদহে বাপি পণ্ডিতের (৩৩) দেহ আনার পরেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। অ্যাম্বুল্যান্সের সেই টাকা মেটাতে নিজেরাই অর্থ তুলে দরিদ্র পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় মানুষজন। সহায়তা করেছেন বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও।
মৃতের কাকা সমীর পণ্ডিত ও ভাই রাজু পণ্ডিত বলেন, “করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা ওই রাতেই ওড়িশা রওনা দিই। বিভিন্ন হাসপাতালে খুঁজেও বাপিকে না পেয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। পরে মর্গে গিয়ে প্রচুর লাশ হাতড়ে ওর মৃতদেহ উদ্ধার করি।” তাঁরা আরও বলেন, “মৃতদেহ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে যাই। অ্যাম্বুল্যান্সের খোঁজ করলে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ২০ হাজার টাকা করে চায়। শেষপর্যন্ত হাতে-পায়ে ধরে একটি অ্যাম্বুল্যান্সকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকায় রাজি করাই। রবিবার ভোরে বাড়িতে ফিরে সেই টাকা কীভাবে শোধ করব তাও বুঝতে পারছিলাম না। পরে গ্রামের লোকজন নিজেরাই চাঁদা তুলে সেই টাকা পরিশোধ করে দেন। বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় এদিন পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন।”
শনিবার কুড়ি হাজার টাকা অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া আগাম মিটিয়ে তবেই কাটোয়ার কৈথন গ্রামের সাদ্দাম শেখের মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে আসা হয়। সাদ্দাম পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। মৃতের দাদা ফিরোজ শেখ বলেন, ‘‘সোনার গয়না বন্ধক রেখে কোনওরকমে ৩০ হাজার টাকা জোগাড় করে ভাইয়ের দেহ আনতে গিয়েছিলাম। ২০ হাজার টাকা অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া আগাম না মেটানো পর্যন্ত গাড়ি ছাড়েনি। হাতে ধরে অনেক অনুরোধ করেছি যাতে ভাড়া কিছুটা কম করে। কিন্তু এক টাকাও কম করেনি। ওই টাকাই দিতে হয়েছে।’’
শনিবার রাতে সাদ্দামের দেহ কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তারপর ময়নাতদন্ত করানো হয়। রবিবার মৃতের দাদা ফিরোজ শেখ বলেন, ‘‘বালেশ্বর হাসপাতাল থেকে চার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের খোঁজ করতে হয়েছিল। যতটা রাস্তা এসেছি তাতে খুব বেশি হলে ১০-১১ হাজার টাকা ভাড়া নেওয়া উচিত। আমাদের কাছ থেকে এই পরিস্থিতির মধ্যে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হয়েছে।’’
এদিকে, জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাড়িতে ফোন করেছিলেন পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানার বলগোনা গ্রামের বাসিন্দা শংকর রায়। ফোন পেয়ে পরের দিনেই ওড়িশায় পৌঁছে যান তাঁর ভাই তাপস রায়। অবস্থা একটু স্থিতিশীল দেখে চিকিৎসকরা বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু দাদাকে কীভাবে বাড়ি ফেরাবেন, চিন্তিত তাপসবাবু। কারণ আহতকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। এদিন তাপস রায় বলেন, ‘‘দাদার কোমরের হাড় ভেঙেছে। একটা হাতের তালু ফুটো হয়ে গিয়েছে। মাথায় আঘাত। অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া বাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া ১২ হাজার টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায় পাব আমরা?’’
বলগোনা গ্রামে এক চিলতে মাটির বাড়িতে থাকে শংকরবাবুর পরিবার। বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী বন্দনাদেবী ও দুই নাবালক সন্তান। দুই ভাই আলাদা থাকেন। শংকরবাবু পেশায় কাঠমিস্ত্রি। রুজিরোজগারের স্বার্থে কেরলে যাচ্ছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেপে। তিনি ছিলেন ওই ট্রেনের এস ৩ কোচে। দুর্ঘটনার পর জ্ঞান হারান। হাসপাতাল নিয়ে আসার পর জ্ঞান ফিরতেই বাড়িতে ফোন করে ঘটনার কথা জানান। বন্দনাদেবী বলেন, ‘‘আমাদের সংসারের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। এই অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া কোথায় পাব?’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.