স্টাফ রিপোর্টার, কলকাতা ও শিলিগুড়ি: শিশু দিলেই ডলার৷ কাঁড়ি কাঁড়ি৷ কোনও ধরাবাঁধা দাম তো নেই৷ যখন যেমন৷ তখন তেমন৷ সেজন্য বিদেশি দুই এজেণ্ট ছিল সক্রিয়৷ তাদের খোঁজে তৎপর পুলিশ৷ আসলে নামেই বয়স্কদের আবাসিক হোম৷ সেখানে কে নেই৷ শিশু, নাবালিকা৷ এমনকী অন্তঃসত্ত্বাও৷ কুমারী অথচ সন্তান ধারণ করেছেন এমন মহিলারও খোঁজ পেয়ে তাঁদের জেরা করা হয় বৃহস্পতিবার রাতেই৷ কীভাবে তাঁরা এখানে এলেন, কুমারী হলেও সন্তান ধারণে রাজি হলেন কেন তা ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের৷ সবমিলিয়ে যেন রহস্য-হোম৷ সেই রহস্য উন্মোচনে জলপাইগুড়ির আশ্রয় হোমের সুপারকেও এবার তলব সিআইডির৷ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হবে, এত বড় চক্র চললেও কেন তিনি কখনও মুখ খোলেননি৷ কেন সরকার বা প্রশাসনের দ্বারস্থ হননি৷ তবে ওই সুপার দীপ্তি ঘোষের দাবি, তিনি কিছুই জানতেন না৷ তাঁকে অন্ধকারে রেখেই এই কাজকর্ম চলত৷ বরং তিনি এখন বিস্ফোরক হোমের কাজকর্ম নিয়ে৷ পুলিশ সূত্রে খবর, জলপাইগুড়ির হোমের চন্দনা চক্রবর্তী ও সোনালি মণ্ডলকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি৷ তারা এখন জেরা করতে চায় সুপার দীপ্তিদেবীকে, যিনি অনেক তথ্যের জোগান দিতে পারবেন বলেই মনে করছেন তাঁরা৷ এরইমধ্যে বিদেশের দু’টি সংস্থার সঙ্গে এই হোমের যোগ রয়েছে বলে জানতে পেরেছে সিআইডি৷ নাম উঠে এসেছে ওই দু’টি সংস্হার যারা শিশু পাচারে যোগাযোগ রাখত৷ তাদের ভারতীয় এজেণ্টের খোঁজ চলছে৷
এদিকে দিদি গ্রেফতার হতেই শিশু পাচারের তথ্য-প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চালাচ্ছিল চন্দনার ভাই মানস ভৌমিক৷ ভূমি রাজস্ব দফতরের এই কর্মীর বিরুদ্ধে শিশু পাচারে যুক্ত থাকার একাধিক প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি৷
এদিকে, শিশু-পাচার কাণ্ডে বিস্ফোরক চন্দনার ‘আশ্রয়’ হোমের সুপার৷ প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে তাঁর বয়ানে চন্দনার নারকীয় কাজকর্মের মুখোশ খুলে গিয়েছে৷ শুক্রবার তাকে শিলিগুড়িতে ডেকে পাঠিয়েছে সিআইডি৷ অন্যদিকে, ধৃত মানসের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র৷ যাতে ঘটনায় তাঁর যোগ স্পষ্ট বলে দাবি তদন্তকারীদের৷ প্রায় ছ’ঘণ্টা জেরার পর বৃহস্পতিবার রাতে মানস ভৌমিককে গ্রেফতার করা হয়৷ তাঁর মোবাইলে কল রেকর্ডের উপর নজর রেখেছিলেন তদন্তকারীরা৷ তাতে দেখা যায়, বারবার একটি ব্যাগ সযত্নে রাখার জন্য বলছেন তিনি৷ ওই ব্যাগেই ছিল শিশু পাচারের বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি৷ সেটি বাজেয়াপ্ত হয়েছে৷ আজ, শুক্রবার তাঁকে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে হাজির করে নিজেদের হেফাজতে নিতে আবেদন জানাতে চলেছে সিআইডি৷ সেক্ষেত্রে এদিন বিকেলেই ধৃত মানস ভৌমিককে শিলিগুড়িতে নিয়ে আসা হতে পারে৷ পিনটেল ভিলেজে হোম-কান্ডে ধৃত চন্দনা চক্রবর্তী ও সোনালি মণ্ডলের মুখোমুখি বসিয়েই মানসকে জেরার কথা ভাবছেন সিআইডি কর্তারা৷
শিশু পাচারে মূল অভিযুক্ত চন্দনা জলপাইগুড়ির এক প্রাক্তন জেলাশাসকের ঘনিষ্ঠ বলে খবর৷ ওই সূত্র ধরেই হোমের আড়ালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা চন্দনার শিশু পাচারের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে বলে অভিযোগ৷ এ বিষয়টিও খোঁজখবর নিচ্ছে সিআইডি৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এনিয়ে তাঁদের কাছে ‘খবর আছে’ বলে জানিয়েছেন৷ ঘটনায় দলের মহিলা মোর্চার নেত্রী জুহি চৌধুরির নাম জড়ানোয় অস্বস্তির মুখে তাঁর পাল্টা দাবি, “জলপাইগুড়ির এই হোম-কাণ্ড নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে৷ এতে তৃণমূলের অনেকের এবং এখানকার এক পূর্বতন জেলাশাসকের নামও শুনতে পাচিছ আমরা৷”
ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার শিশু সুরক্ষা এবং শিশু কল্যাণ বিভাগের অনেককেই জেরায় ডাকা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন তদন্তকারীরা৷ একইসঙ্গে চন্দনার হোম থেকে উার হওয়া ফাঁকা প্যাডের সূত্র ধরে জনৈক ডাঃ চন্দকে জেরায় ডাকতে চলেছে সিআইডি৷ ডাকা হচেছ হোমের প্যানেলভুক্ত আরও তিন চিকিৎসকের৷
ধৃত মানস ভৌমিক চন্দনার শিশু পাচারের ব্যবসায় মূলত যোগসূত্র তৈরির কাজ করতেন বলে জানতে পেরেছে সিআইডি৷ চন্দনার হোমে কাউন্সেলর ছিলেন তিনি৷ আবাসিক ও কুমারী মা-দের বুঝিয়ে হোমে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করতেন৷ নিজে সরকারি কর্মী হওয়ার সুবাদে প্রশাসনিক মহলকে কাজে লাগিয়ে নথিপত্র জোগাড়ের বিষয়টি দেখতেন তিনি, এমনটাই অভিযোগ৷ এ ছাড়াও দত্তকের মোড়কে শিশু পাচারে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও দেখভালের দায়িত্ব ছিল মানসের উপর, এমনটাও শোনা যাচ্ছে৷ দিদি গ্রেফতারের পর থেকেই নিজেকে আড়াল করে ফেলেন মানস৷ জলপাইগুড়ি শহরের চার নম্বর গুমটি এলাকার বাড়ি থেকে নথিপত্র সরানোর কাজও শুরু করে দেন৷ কিছু নথি পুড়িয়েও ফেলা হয়, এমনটাও জানতে পেরেছে সিআইডি৷
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ি থেকে ব্যাগভর্তি নথি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই তাঁকে ধরে ফেলেন রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের কর্তারা৷ শুরু হয় ম্যারাথন জেরা৷ সন্ধ্যায় তাঁকে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায় নিয়ে এসেও জেরা করা হয়৷ শিশু পাচার কাণ্ডে চন্দনার বাপের বাড়ির আরও কয়েকজন সদস্যকে নজরে রেখেছে সিআইডি৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.