সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: কথায় আছে, ‘আশিতে আসিও না।’ অর্থাৎ আশি বছর বয়স হলেই মানুষ নাকি জরাগ্রস্ত হয়। কর্মক্ষমতা হারিয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তবে এ ধারণা খাটে না মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের একাশি ছুঁইছুঁই এবারের শাসক দলের প্রার্থীর ক্ষেত্রে। যদিও বিরোধী শিবির সেটাকেই হাতিয়ার করে নেমে পড়েছে ভোটের ময়দানে। বিরোধীদের এই ইস্যুকে কিন্তু একেবারে পাত্তাই দিচ্ছেন না এই কেন্দ্রের দু‘বারের তৃণমূল সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়া। যিনি মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন৷
২০০১ সালে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে মন্দিরবাজার বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে বিধায়ক হন পুলিশের প্রাক্তন ডিআইজি। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মথুরাপুর কেন্দ্র থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং জিতেওছিলেন। দ্বিতীয় মনমোহন সিং মন্ত্রিসভায় জাটুয়া ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই তিনিই এবারও ভরসা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একসময় জল্পনা শুরু হয়েছিল বয়সের কারণে তাঁকে এবার টিকিট দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েই। কিন্তু সব জল্পনায় জল ঢেলে সেই তিনিই আরও একবারের জন্য মথুরাপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী।
অনেক টালবাহানার পর এই কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী হয়ে এখানে লড়ছেন শ্যামাপ্রসাদ হালদার। ৪৬ বছরের শ্যামাপ্রসাদবাবু এই কেন্দ্রেরই অন্তর্গত মগরাহাট (পশ্চিম) বিধানসভার শিরাকোলের বাসিন্দা। অর্থাৎ ভূমিপুত্র। বিদ্যানগর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর৷ তবলা শিক্ষাতেও রয়েছে ডিপ্লোমা। ২০১৬-তে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রতিপক্ষ শাসক দলের প্রার্থী সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “উনি প্রবীণ মানুষ। শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বয়সটা অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। নদীনালায় ঘেরা এই কেন্দ্র। বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানো ওনার পক্ষে কষ্টসাধ্যও বটে। এলাকার উন্নতি হবে কিন্তু কী করে?”
মথুরাপুর কেন্দ্রে এবার চতুর্মুখী লড়াই হচ্ছে। তৃণমূল, বিজেপি ছাড়াও ভোটে লড়ছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। বামপ্রার্থী চল্লিশ ছুঁইছুঁই সিপিএমের ডা: শরৎচন্দ্র হালদার। পেশায় চিকিৎসক। মন্দিরবাজারের বিদ্যাধরপুর এলাকায় বাড়ি। অর্থাৎ তিনিও ভূমিপুত্র৷ ২০১১ ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মন্দিরবাজার বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন।
বিজেপি প্রার্থীর মতো সরাসরি বিদায়ী সাংসদ চৌধুরী মোহন জাটুয়ার বয়সের ভার নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও তিনি জানিয়েছেন, “এই কেন্দ্র থেকেই দু’বারের সাংসদ, একবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন সি এম জাটুয়া। কিন্তু এলাকার মানুষের জন্যে তিনি করলেন কী? আয়লা অধ্যুষিত এলাকায় এখনও নদীবাঁধ তৈরি হয়নি। জোয়ারের সময় নদী ও সমুদ্রের জল ঢুকে নষ্ট করছে ফসল। মাটির বাড়িতে জল ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি। আশ্রয়হীন হচ্ছে গরীব মানুষ। প্রত্যন্ত এলাকায় এখনও চলছে পানীয় জলের হাহাকার। অথচ এলাকার মানুষ গত পাঁচ বছরে দেখতে পাননি তাঁদের সাংসদকে। মানুষের কাছে পৌঁছে বুঝতে পারছি তাঁরা এবার বয়সে নবীন প্রার্থীকেই এই কেন্দ্র থেকে জিতিয়ে আনতে দিন গুনছেন।” প্রতিদ্বন্দ্বী সমস্ত দলের প্রার্থীদের থেকে তুলনামূলকভাবে বয়সে তরুণ হওয়ায় অ্যাডভান্টেজ যে তাঁরই, সেটাই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি বাম সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী।
আর এসব শুনে হেসেই কুপোকাত একাশির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো তারুণ্যে ভরপুর চৌধুরী মোহন জাটুয়া। আদতে এই লোকসভা কেন্দ্রেরই ভূমিপুত্র বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা তিনি। বললেন, “পুলিশে কাজ করতাম। অনেক শারীরিক কসরৎ করেছি তাই বয়সটা আমার কাছে এখনও কোনও সমস্যাই নয়। যাঁরা এখানে প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের তুলনায় আমি অনেকটাই ফিট। ভোটপ্রচারে আমি তাঁদের থেকে এর মধ্যেই অনেক বেশি এলাকায় পৌঁছেছি। প্রায় প্রতিদিনই এক-দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে মিছিল করছি, কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট। সকলেই আমাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন। সাংসদ হিসেবে হ্যাট্রিক তো করবই, চেষ্টা করছি গতবারের তুলনায় জয়ের ব্যবধান আরও বাড়ানোর। বিরোধীরা যতই ‘কাজ হয়নি’ বলে কুৎসা করুক তাতে ওঁদের বিশেষ সুবিধে হবে না।”
চতুর্মুখী লড়াইয়ে প্রথম দফার প্রচারে এই কেন্দ্রে অনেকটাই কিন্তু পিছিয়ে রয়েছেন কংগ্রেসের প্রার্থী কৃত্তিবাস সর্দার। কুলপির বাসিন্দা মথুরাপুর কেন্দ্রের আর এক ভূমিপুত্র তিনি। প্রচারে পিছিয়ে থাকা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন তিনি। তাঁর মতে, এখনও অনেক সময় রয়েছে। তাঁর প্রচারেও ঝড় উঠবে। আপাতত বুথ স্তরের কর্মীদের নিয়ে বৈঠকে ব্যস্ত তিনি। তাঁর বড় চিন্তা সমস্ত বুথে এজেন্ট দিতে পারবেন কি না৷ ভোটে জেতার থেকেও শীর্ষ নেতৃত্বের চোখে নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা প্রমাণেই আগ্রহ বেশি কংগ্রেস প্রার্থী কৃত্তিবাস সর্দারের৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.