সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: মাঝে এক দশকের ব্যবধান। তবু জনপ্রিয়তা অটুট। যা দেখে আপ্লুত এক সময়ের পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণ কমিটির অবিসংবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতো। শনিবারই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আর রবিবার নিজের এলাকায় রীতিমত নায়কোচিতভাবে ফিরলেন তিনি। ভাসলেন জনজোয়ারে। ফুল, মালায় তাঁকে বরণ করে নিলেন লালগড়বাসী। এসব দেখে আবেগপ্রবণ ছত্রধর জানালেন, মানুষের পাশে থেকে তিনি কাজ করে যেতে চান। তবে কি রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরবেন? যোগ দেবেন রাজ্যের শাসকদলে? এ নিয়ে জল্পনা জিইয়ে রাখলেন ছত্রধর।
এক দশক পর মুক্ত আকাশের নিচে পা রাখলেন জনসাধারণ কমিটির নেতা। ২০০৮ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কনভয়ে হামলার অভিযোগে জেলবন্দি হয়েছিলেন ছত্রধর মাহাতো। আইনের বিচারে প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও, ২০১৯ সালে সাজার মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া হয়। শনিবার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। রবিবার কলকাতা থেকে গাড়ি করে স্ত্রী নিয়তি মাহাতো, ছেলে এবং তাঁর একসময়ের ছায়াসঙ্গী তথা বর্তমানে বিনপুর ১-এ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি শ্যামল মাহাতো-সহ অন্যান্য প্রক্তন সহযোদ্ধার সঙ্গে ছত্রধর লোধাশুলি, ঝাড়গ্রাম, দহিজুড়ি হয়ে লালগড়ে ফেরেন। এদিন তাঁর ফেরার পথে ছিল শুধু জনতার ভিড়। একবার চোখের দেখা দেখতে, স্পর্শ পেতে মানুষ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
প্রথমে লোধাশুলিতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন জনসাধারণ কমিটির নেতা। সেখানে অপেক্ষরত জনতা তাঁকে ফুল,মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানান। মানুষের উদ্দেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। এখান থেকে ঝাড়গ্রাম শহরের পুরাতন ঝাড়গ্রাম, ঝাড়গ্রামের পাঁচমাথা মোড় এবং দহিজুড়িতেও একইভাবে তাঁকে দেখার জন্য প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছত্রধর মাহাতোও তাঁদের দেখে ফের গাড়ি থেকে নেমে আসেন, হাত মেলান। নিজের বক্তব্যে আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেননি একসময়কার এই দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা। তিনি পরিষ্কার বলেন, “এক দশক পরেও এত মানুষ আমারা জন্য অপেক্ষা করে আছেন, তা ভাবতে পারিনি। আমি মানুষের পাশে আছি আর তাঁদের পাশে থেকে কাজ করে যেতে চাই।” লালগড় সেতু ধরে প্রায় এক কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা মানুষের ভিড়ে পা মিলিয়ে হেঁটে ছত্রধর পৌঁছে যান লালগড় এসআই চকে। এখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন মা বেদনাবালা মাহাতো। তাঁকে দেখেই সজল চোখে জড়িয়ে ধরেন। এসআই চক তখন লোকে লোকারণ্য।
হবে নাই বা কেন? এই এলাকাকে অনুন্নয়নের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে ছত্রধরের ভূমিকা কি কম? ২০০৮ সালে মাওবাদীদের অত্যাচার পূর্ণ জঙ্গলমহলে পুলিশের পালটা দমনপীড়নমূলক পদক্ষেপ, অনুন্নয়ন, রাস্তাঘাট, প্রত্যন্ত এলাকায় খাদ্যের অভাব – এসব নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন লালগড়ের আমলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছত্রধর মাহাতো। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, নাশকতা-সহ অসংখ্য অপরাধে মামলা রুজু করে। ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর লালগড়ের ছোটপেলিয়া থেকে পুলিশ সাংবাদিকের ছদ্মবেশে ছত্রধরকে গ্রেপ্তার করে। সেও এক অধ্যায় ছিল বটে।
১০ বছর পর নিজের জন্মভূমিতে পা রেখে লালগড়ের উন্নয়ন দেখে রীতিমত খুশি ছত্রধর। তিনি এর জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে অজস্র ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, “আমার জন্মভূমি লালগড়। চব্বিশ ঘন্টা এখানে কাটাতাম। আজ আমার সেই পুরনো লালগড়কে চিনতে পারছি না। রাস্তাঘাট-সহ এত উন্নয়ন দেখে কোন রাস্তা দিয়ে আসছি তা বুঝতেই পারছিলাম না। প্রচুর কাজ এবং পরিবর্তন হয়েছে। সবথেকে বড় বিষয়, মানুষের খাদ্য সংকট আর নেই। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। আমি মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে চাই। তবে তৃণমূলে যোগদান নিয়ে এখনই কিছু ভাবিনি।”
তবে এদিন ছত্রধরের সঙ্গে যে জনতার ভিড় ছিল, তাতে উড়েছে তৃণমূলের পতাকা, উঠেছে স্লোগান। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাঁরা আজ আমার জন্য এসেছেন, তাঁরা আমার একসময়ের সঙ্গী ছিলেন। এখন তাঁরা নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক দল করতেই পারেন।” জেলার দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষের জন্য এদিন খিচুড়ি রান্না করা হয়েছিল। ছত্রধর নিজেও লালগড়ের এসআই চকে সবার সঙ্গে পাত পেড়ে খিচুড়ি খেলেন। তিনি যে মানুষের মধ্যে ছিলেন এবং আছেন, তা এদিন স্পষ্ট হয়ে গেল জনতার ভিড়ের ছবিতে। এবার তাঁর নতুন পথচলার শুরু।
ছবি: প্রতীম মৈত্র।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.