সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বিধানসভা ভোট পরবর্তী সময়ে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হলেই তা রাজনৈতিক খুন বলে দাবি করত বিজেপি ও অন্য বিরোধী দলগুলি। রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলত। এমনকী, ভোট পরবর্তী হিংসার কথা বলে সিবিআই (CBI) তদন্তও দাবি করে হাই কোর্টে (Calcutta High Court) যায় তারা। হাই কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশও দেয় অনেকগুলি ঘটনায়। পূর্ব বর্ধমানের রায়নার বিজেপি কর্মীর বাবার ‘খুনের’ মামলায় রাজ্যের শাসক দলের দাবিকেই কার্যত সিলমোহর দিয়েছে আদালতে পেশ করা সিবিআই রিপোর্ট।
রায়নার বাসুদেবপুর গ্রামের বিজেপি কর্মী প্রদীপ রুইদাসের বাবা কার্তিক রুইদাস (৫৯)-এর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনার সিবিআই তদন্ত চলছিল ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায়। সেই মামলায় বর্ধমান সিজেএম আদালতে সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার সাব ইন্সপেক্টর গৌতম যোশী চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, খুনের অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই। কার্তিক রুইদাস আত্মঘাতী হয়েছেন বলেও সিবিআই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনায় কার্তিকবাবুর বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগেরও কোনও প্রমাণ পায়নি সিবিআই। সিবিআই রিপোর্ট পাওয়ার পর বর্ধমান আদালতের সিজেএম চন্দা হাসমত অভিযোগকারী তথা মৃতের ছেলে প্রদীপ দাসের মতামত জানতে চেয়ে নোটিস পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২১ সালের ৫ মে রায়নার বাসুদেবপুর গ্রামে বাড়ির অদূরে একটি গাছে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। রায়না থানার পুলিশ দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়। পুলিশও তদন্ত করে মানসিক অবসাদে ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন বলে রিপোর্ট দেয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও ভোট পরবর্তী হিংসায় রাজনৈতিক খুন বলে দাবি করা হয়। পুলিশি তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে হাই কোর্টে মামলা করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানায় মৃতের পরিবার। হাই কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। মৃতের ছেলে প্রদীপবাবু সিবিইইকে অভিযোগে জানান, বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার দিন তাঁদের বাড়িতে হামলা করা হয়। ভয়ে তিনি পালিয়ে যান। পরদিন সকালে তাঁর বাবা ফোন করে বাড়ি আসতে বলেন। ওইদিন রাতে ফের হামলা করা হয় তাঁদের বাড়িতে। তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়। পরদিন সকালে তাঁর বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। পরে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় তাঁর বাবার। তাঁর দাবি, খুন করে তাঁর বাবার দেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
খুনের মামলা রুজু করে সিবিআই তদন্তে নামে। ময়নতদন্তের রিপোর্ট পর্যালোচনা করতে দিল্লি এইমস-এ পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট দিয়েছেন আত্মহত্যার ঘটনা বলেই। সিবিআই তদন্তে নেমে জানতে পারে প্রদীপ ২০২০ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। কার্তিকবাবু তৃণমূলই করতেন। সিবিআই পরিবারের সকল সদস্যর সঙ্গে কথা বলে। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গেও কথা বলে। তারা জানতে পারে কার্তিকবাবুর বাড়িতে হামলাই হয়নি। ভাঙচুর বা হুমকি দেওয়ার কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে ফল প্রকাশের দিন গ্রামে মিছিল করে তৃণমূল। প্রদীপবাবু বাড়ির টিনের দরজায় ধাক্কাধাক্কির কথা জানিয়েছিলেন। তেমন কোনও প্রমাণ পায়নি সিবিআই। হাওয়ায় টিনের দরজায় শব্দ হতে পারে বলে সিবিআই জানিয়েছে।
সিবিআইয়ের এই রিপোর্টে অস্বস্তিতে পড়েছে রাজ্যের বিরোধী দল। এখন সিবিআই তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। বিজেপির বর্ধমান সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক মৃত্যঞ্জয় চন্দ্র বলেন, “সিবিআই এমন রিপোর্ট দিয়ে থাকলে আমরা তা পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য দাবি করব। গ্রামে যখন সিবিআই তদন্তে যায় তখন গ্রামের মানুষ এতটাই ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন যে স্পষ্ট করে সত্যি কথা বলতে পারেননি। ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস এতটাই হয়েছে সকলে প্রাণভয়ে ভীত ছিলেন। সিবিআই তদন্ত পুনর্মূল্যায়ন করলে সত্যটা সামনে আসবে আমাদের এলাকার কার্যকর্তারা যে রিপোর্ট দিয়েছেন তাতে কার্তিকবাবুর বাড়িতে হামলা হয়েছিল এবং তাঁকে খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিজেপি লাশের রাজনীতি করে এটাই প্রমাণ হল। আর সেটা প্রমাণ করে দিল তাদেরই অধীনে থাকা সিবিআই। ওরা অপেক্ষায় কখন একটা ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যাবে। আর সেটা নিয়ে লাশের রাজনীতি করবে। মিথ্যাচার ছাড়া কিছু জানে না ওরা।” মৃতের ছেলে প্রদীপবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.