সুনীপা চক্রবর্তী: একটা মেলা৷ তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রেম-ভালবাসার গাথা৷ মানুষ এখানে আসে প্রেম খুঁজে নিতে৷ ভালবাসা নিয়ে যেতে৷ বর্তমানে ধর্ম, সম্প্রদায়ের বেড়া ভেঙে সমস্ত শ্রেণির মানুষ বাবা ভৈরবের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করতে আসেন৷ আসেন নিজেদের বিশ্বাসে মনের কামনা পূরণ করতে৷ রাঢ়বাংলার সবচেয়ে বড় মেলা বেলপাহাড়ির ভেলাইডিহা অঞ্চলের ওঁড়গোন্দার পাটাবিঁধার মেলা৷ দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিন তথা দশমী থেকে শুরু করে দ্বাদশী পর্যন্ত এই মেলায় শামিল হল বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা-সহ অন্যান্য রাজ্যের আদিবাসী মানুষজন৷ কয়েকশো বছর প্রাচীন পাটাবিঁধার মেলায় বহু আগে ছিল কেবল আদিবাসীদের মেলা৷ মেলায় অ-আদিবাসীদের প্রবেশ ছিল নিষেধ৷ বর্তমানে সেই বেড়াজাল নেই৷ দশমীর দিন ওঁড়গোন্দায় বিশাল মাঠের মধ্যে অসাধারণ ভগ্ণ স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে অবস্থানরত বাবা ভৈরব জিউয়ের পুজোয় এবং ওই দিনের মেলায় অংশ নেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ৷ একাদশী এবং দ্বাদশীর মেলা মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেলা৷ যদিও বর্তমানে অংশ নেয় জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে৷ বাবা ভৈরবের পুজো করেন স্থানীয় পাহন সম্প্রদায়ের রহিনী পাহান এবং গোবিন্দ পাহান৷ পরব ছাড়াও সারাবছর মানুষজন নিজেদের মতো করে আসেন পুজো দিতে৷ তবে বিশাল বটগাছের নিচে ভৈরব বাবাকে কেন্দ্র করে বছরে এই তিনদিন সবচেয়ে বড় মেলাটি জমে ওঠে৷
স্থানীয় লোকশ্রুতি, ঝাড়খণ্ডের ধলমঙ্গল এস্টেটের রাজার কুলদেবী ছিলেন দেবী রঙ্কিনী৷ তিনি জঙ্গলমহল-সহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষজনকে রক্ষা করতেন৷ তিনি ছিলেন ত্রাতা৷ জানা যায় দেবী রঙ্কিনী ওঁড়গোন্দায় তার স্বামী ভৈরবের সঙ্গে মিলিত হতে আসতেন৷ আর সেই জন্যই এই স্থানটি প্রেমের স্থান হিসাবে জনপ্রিয় হয়৷ স্থানীয়রা আরও বলেন, মন্দির তৈরির সময় ভোর হয়ে যাওয়ায় মুরগি ডাকার জন্য কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়৷ জৈন স্থাপত্যের আদলে ভৈরব থানটিকে স্থানীয় মানুষ বলেন একটি মৃত আগ্নেয়গিরি৷
তবে ঐতিহাসিকদের মতে, একসময় পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে জৈনদের যাতায়াত ছিল৷ এই ভৈরব থানটি আসলে জৈন ভৈরবনাথের উপাসনা স্থল ছিল৷ কালের নিয়মে এই ভৈরব থানটি আদিবাসী অধ্যুষিত মানুষদের একটি ধর্মীয় স্থানে পরিণত হয়৷ দশমী থেকে শুরু হয় বিশাল মেলা৷ ওঁড়গোন্দা এলাকার ১৭টি মৌজার আদিবাসী প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়েছে পাটাবিঁধার মেলা কমিটি৷ একাদশী, দ্বাদশীর মেলার হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ যোগ দেন৷ মেলাস্থলকে ঘিরে সারারাত ধরে চলে দাশায়, পরব-সহ নানা আদিবাসী লোকসংস্কৃতির উৎসব৷ কয়েকশো স্টল বসে মেলা প্রাঙ্গণ ঘিরে৷ চলে মন দেওয়া-নেওয়া৷ পাত্র-পাত্রীরা নির্বাচন করে তাদের জীবনসঙ্গী৷
স্থানীয় যুবক বিমল মুর্মু, কানাইলাল সোরেন বলেন, “আমাদের এই মেলা মিলন, প্রেম, ভালবাসা, সম্প্রীতির মেলা৷ মেলার নিজস্ব কমিটি থাকলেও বর্তমানে ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকেও মেলাটি যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে এর জন্য নজর রাখা হয়৷ বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বংশীবদন মাহাতো বলেন, “আমরা লক্ষ্য রাখি, কোনও ধরনের সমস্যা হলে আমরা পাশে রয়েছি৷ কোনও ধরনের প্রয়োজন পড়লে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করব৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.