সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সামনেই পরীক্ষা। তবুও বিরাম নেই। ঘরে যে অভাব। তাই রাত জেগে সরস্বতী প্রতিমা (Saraswati) গড়ছে দুই ভাইবোন। স্বহস্তে তৈরি প্রতিমা বিক্রির অর্থেই লেখাপড়ার খরচ আসবে। সে অর্থে বিদ্যাদেবীই তাদের বিদ্যালাভে সাহায্য করেন! বাগদেবীর কাছে তাদের প্রার্থনা, পরীক্ষার ফল যেন ভালো হয়। সেইসঙ্গে মনের আরও একটি সুপ্ত ইচ্ছে। এই শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়েই যেন তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
পুরুলিয়ার (Purulia) জয়পুর ব্লক সদরের চটিপাড়ার পলাশ সূত্রধর ও মিতালি সূত্রধর। চাষ মোড়-তুলিন রাজ্য সড়কে জয়পুর থানার অদূরেই তাদের বাড়ি। সেখানেই দুর্গা মন্দির ভাড়া করে প্রতিমা তৈরি করছে পলাশ-মিতালি। আসলে এটাই যে তাদের পারিবারিক পেশা। এই কাজ করেই যে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। সংসার যে চলে প্রতিমা গড়েই। তাই পরীক্ষা থাকলেও পেটের টানে এই কাজ করতেই হয় পলাশ ও মিতালিকে।
পলাশ জয়পুর বিক্রমজিৎ মেমোরিয়াল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে (Political Science) অনার্স নিয়ে পড়ছে। আগামী ৩ মার্চ থেকে তার ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। অন্যদিকে বোন মিতালি জয়পুরের (Jaipur) আরবিবি হাইস্কুলে একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্রী। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তার পরীক্ষা শুরু। তাই বইয়ের পাতা যেমন ওল্টাচ্ছে। তেমনই রাত জেগে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। সরস্বতী পুজো ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকায় সকালেও তারা একপ্রস্থ এই কাজ করছে।
পলাশ-মিতালির অভিভাবকরাও আলাদাভাবে প্রতিমা তৈরি করছেন। মাঝারি-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০টি প্রতিমা তৈরি করছেন তারা। এর মধ্যে পলাশের দায়িত্বে রয়েছে ৯০টি। মিতালি বানিয়েছে ৫০টি প্রতিমা। ভাই-বোনের সরস্বতী মূর্তির কাঠামো তৈরি হয়ে রঙ পড়ে গিয়েছে। এবার শুধু শাড়ি, গয়নায় সাজিয়ে তোলার কাজ। পলাশের কথায়, “এটা আমাদের পারিবারিক কাজ। সংসার চালাতে আমাদের এই কাজ করতেই হবে। না হলে পেট চলবে না। তাই সামনে পরীক্ষা থাকলেও তার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের এই প্রতিমা তৈরি করতে হচ্ছে।” মিতালি বলে, “আমার পরীক্ষা একেবারে দোরগোড়ায়। তাই আমি ৫০টা প্রতিমা তৈরি করার দায়িত্ব নিয়েছি। কাজ অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছি। আর কয়েকটা রাত জাগলেই ফিনিশিং টাচ দিয়ে বিক্রি করতে পারব।” মাঘের এই শীতে তাদের প্রতিমা তৈরি করতে করতে রাত দুটো বেজে যাচ্ছে।
ভাইবোন দুজনেরই এই প্রতিমা তৈরির কাজে হাতেখড়ি তাদের বাবা-মা। তার মা বুবুন সূত্রধর বলেন, “বছর আটেক আগে ওর বাবার ভীষণ শরীর খারাপ হয়েছিল সরস্বতী পুজোর সময়। তখন আমি আর পলাশ মিলে সমস্ত সরস্বতী প্রতিমা তৈরি করি। তখন থেকেই পলাশের এই কাজে হাত বসে গিয়েছে।” মিতালির কথায়, “দাদা খুব সুন্দর প্রতিমা তৈরি করে। ওর এক একটা প্রতিমার ফিনিশিং এত সুন্দর চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই ওর ভাবনাতেও আমি কাজ করি।”
পলাশ ও মিতালি যে শুধুই সরস্বতী প্রতিমা গড়ে তা নয়। তারা দুজনই মনসা, লক্ষ্মী, বিশ্বকর্মা, মা কালীর প্রতিমা বানাতে পারেন। আর পলাশ একটু এগিয়ে প্রতিমা তৈরি করেন দুর্গারও। মনসা ও সরস্বতী পুজোর সময় তারা দুবার ওই মন্দির ভাড়া নেন। এজন্য ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আগে থেকে সরস্বতী প্রতিমার বরাত সেভাবে আসে না। প্রতিমা তৈরি করে রাখে। পুজোর আগের রাত পর্যন্ত সব বিক্রি হয়ে যায়। একটি ছোট প্রতিমার দাম ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। বড় প্রতিমার দাম ৮০০ থেকে সাড়ে ৮৫০। এছাড়া পলাশ তাদের এলাকার একটি ক্লাবের সরস্বতী প্রতিমা তৈরি করছে। যার দাম সাড়ে ৩ হাজার। তার কথায়, “এলাকার ক্লাবের পুজো। তাই ওই প্রতিমা ২ হাজার টাকায় দেবো। এটা আগে থেকেই বরাত পেয়েছি।” তাদের মায়ের কথায়, “আমার ছেলেমেয়ে সত্যিই ভীষণ ভালো। প্রতিমা গড়ে লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি তারা সংসারেরও হাল ধরে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.