সুমন করাতি: প্রতিমা গড়ার সময় মৃৎশিল্পীদের নিরামিষ খেতে হয়। ভুল করে কেউ আমিষ খাবার খেয়ে নিলে বা মদ্যপান করলে আটচালার নাটমন্দিরে সাপ, বিছে-সহ বিষাক্ত কীটপতঙ্গের আনাগোনা বাড়ে। পুরাতন বাংলার গুচ্ছ লোকাচার, লোককথা আর রহস্যে পরিপূর্ণ হুগলি জেলার হরিপালের সরকার বাড়ির পুজো ।
২২০ বছরের প্রাচীন এই পুজোর (Bonedi Barir Durga Puja) সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের বিশ্বাস। এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা এক মহিলা। হরিপালের অলিপুর সরকার বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। দেবী এখানে খুবই জাগ্রত। লোকমুখে শোনা যায়, এখানে প্রতিমা গড়ার সময় মৃৎশিল্পীদের নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হয়। ভুল করে কেউ আমিষ খাবার খেয়ে নিলে বা মদ্যপান করলে আটচালার নাটমন্দিরে সাপ, বিছে-সহ বিষাক্ত কীটপতঙ্গের আনাগোনা বাড়ে। কথিত আছে, একবার পোকামাকড়ের ভয়ে মৃৎশিল্পীদের মাঝপথেই পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল।
সাধারণত, বনেদি বাড়ির পুজোর (Bonedi Barir Durga Puja) ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বেশিরভাগ পুজোর প্রতিষ্ঠাতা সেই পরিবারের কোনও পুরুষ। কিন্তু সরকার বাড়ির পুজো ব্যতিক্রমী। এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হলেন সরকার বাড়ির কর্তা বঙ্কুবিহারী সরকারের স্ত্রী নীরদাময়ী দাসী। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে বাড়িতেই দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। সরকার পরিবারের সদস্য তপন, সঞ্জীব ও সত্যজিৎরা বলেন, পুরনো মন্দির, সিংহদুয়ার বর্তমানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পরিবর্তে নতুন করে তৈরি হয়েছে আটচালা ও নাটমন্দির। একসময় জমিদারি ছিল এই পরিবারে। বর্ধমানের রাজাকে তার খাজনা দেওয়া হত। ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। পরিবারের অনেকেই কর্মসূত্রে এখন বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছে। তবে পুজোর সময় সকলেই গ্রামের বাড়িতে মিলিত হন। বাড়তে বাড়তে এই পরিবারে সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ১৩০। একচালার মূর্তিতে ষোড়শোপচারে নিষ্ঠাভরে পুজো হয় এই সরকার বাড়িতে।
কথিত আছে, একসময় বাড়ির সিংহদুয়ার ভেঙে ডাকাত দল ঢুকেছিল বাড়িতে। ডাকাত দল দরজা ভাঙার পর দেখতে পায়, দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বয়ং দেবী দুর্গা। ওই দৃশ্য দেখে তারা ডাকাতি না করেই ফিরে যায়। পরে, ডাকাতদলের সদস্যদের মুখে মুখেই প্রচলিত হয়ে যায় সেই কথা। আগে একটা সময় সরকার বাড়ির পুজোতে মোষ ও ছাগল বলি হত। শোনা যায়, বছর ষাটেক আগে যে ছাগলটি বলি দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল সেটি সাপের কামড়ে আগেই মারা যায়। তখন পরিবারের তৎকালীন কর্তা নীলরতন সরকারের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় পশুবলি প্রথা। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত আদা, ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয়।
সরকার বাড়ির দেবী যে অত্যন্ত জাগ্রত তার সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা প্রতিমা শিল্পী প্রদ্যুৎশী। তিনি বলেন, “গত ১০ বছর ধরে আমি প্রতিমা তৈরি করছি এখানে। আমার আগে যিনি এখানে প্রতিমা তৈরি করতেন তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই প্রতিমা তৈরি করলে মাছ, মাংস, মদ্যপান কোনও কিছুই করা যাবে না। এরপর একদিন তিনি মাংস খেয়ে প্রতিমা তৈরি করতে এসেছিলেন। তার পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। সাপ, বিছে-সহ অন্যান্য বিষাক্ত কীটপতঙ্গে ভরে উঠেছিল গোটা মন্দির। ভয়ে তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হন।” রহস্য এখানেই শেষ নয়।
তিনি আরও জানান, অন্যান্য জায়গায় প্রতিমা করতে যদি তিন দিন সময় লাগে সেই কাজ করতেই সরকার বাড়িতে লেগে যায় কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় দিন। কারণ এখানে রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সকলে যে যেরকম অবস্থায় থাকেন সেই অবস্থাতেই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ মাটি হাতে ঘুমোন, কেউ আবার প্রতিমার সাজ হাতে ধরেই চলে যান ঘুমের রাজ্যে। মহালয়ায় হয় দেবীর চক্ষুদান। সেদিন নির্জলা উপোস করতে হয়। প্রতিবছর বিভিন্ন জায়গা থেকেই এই জাগ্রত দেবী দুর্গার মূর্তি দর্শন করতে হরিপালে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.