অরিজিৎ গুপ্ত, হাওড়া: সামনে ফাঁকা জায়গা। একটু এগোলেই পুরনো ঠাকুর দালান। দেওয়ালে শ্যাওলা। ফাঁকে ফাঁকে মাথা তুলেছে ফার্ন। উপরে টিনের ছাউনি। সেখানেই তৈরি হচ্ছে মায়ের মূর্তি। অর্ধেক তৈরি মূর্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে মা দশভূজা নন। দুটি হাত। নেই অসুর। রয়েছে চার ছেলে-মেয়ে। রূপ পাচ্ছেন দেবী ‘অভয়া’। এবার হাওড়ার শিবপুরের পাল বাড়ির পুজোর ৩৫৩ বছর।
এই বাড়িতে মায়ে রূপ ও রীতি প্রতিপদে চমকে দেওয়ার মতো!
এখানে দেবী অসুর বিনাশী নন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ এক চালায়। বংশ পরম্পরায় কুমোরটুলির থেকে শিল্পী এসে প্রতিমা তৈরি করেন। ঢাকিরাও বংশানুক্রমে নিজেদের কাজ করেছেন। মহালয়ার পর থেকে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে শুরু হয় পুজো। এত অবধি অনেক বনেদি বাড়িতেই এই রীতি মানা হয়।
চমক এর পরেই! শুক্লা তিথিতে মায়ের হয় বোধন। সপ্তমীতে কলাবউ বা নবপত্রিকা স্নান গঙ্গায় নয় বাড়িতেই হয়। এই পুজোতে এখনও চালু রয়েছে পশুবলি! মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর অর্থাৎ সপ্তমীর দিনেই হয় পাঁঠা বলি! তবে অষ্টমীর পুজোতে বলি দেওয়া হয় না। পরিবারের ৩০-৪০ জন মহিলাকে নিয়ে ধুনোপোড়ানো হয়। তার পরই সন্ধিপুজো। সেই সময় আরও একটি পাঁঠাবলি রীতি আছে। নবমীর দিন সকালে বাড়ির ভোগ হয়। সেই সময় আরও একটি পাঁঠাবলি হয়। তার পর ৫টি ফলের বলি। শেষে একটি মহিষ বলি! হ্যাঁ, মহিষ বলি এখনও চালু হাওড়ার পাল বাড়িতে। বলি যাঁরা দেন তাঁরাই দেহটি নিয়ে যান। মহিষের মাথা নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গায়।
তবে পুজোর শুরুর বছরগুলিতে মোষ বলির প্রথা ছিল না। কথিত আছে, বহুদিন আগে শিবপুরের রায়চৌধুরি পরিবারে দুর্গাপুজো হত। এই পালবাড়ির দেবী ‘অভয়া’র বোন ‘মায়া’কে দুর্গারূপে পুজো করা হয়। সেই রায়চৌধুরি বাড়িতে মোষ বলির প্রথা ছিল। একবার নাকি সেখান থেকেই একটি মোষ হাঁড়ি কাঠে মাথা দিয়ে শিবপুরের পাল বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকেই পাল বাড়িতে শুরু মহিষ বলি।
নবমীর পুজোর পর মায়ের হোম দক্ষিণান্তর হয়। তার পরই শুরু বিসর্জনের প্রস্তুতি। বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির মহিলারা সিঁদুর খেলেন।
হাওড়ার অন্যতম প্রাচীন এই পুজো শুরু করেন সর্বেশ্বর পাল। ধুমধাম করে পুজো হত। পরে সর্বেশ্বরবাবু পুজোর দায়ভার দেন বটকৃষ্ণ পালকে। সেই থেকে তিনি ও তাঁর বংশধরেরা পুজো করে আসছেন। এক সময়কার সেরা এই পুজো এখন কিছুটা জৌলুস হারিয়েছে। পরিবারের তরফ থেকে একটি ট্রাস্ট তৈরি করা হয়েছে। সেই তহবিলে জমানো টাকা থেকেই পুজোর খরচ হয়।
পরিবারের সদস্য সুশান্ত পাল বলেন, “সকলের টাকা দিয়ে আমরা পুজো করি। কতদিন চালাতে পারবে জানি না। মায়ের ইচ্ছে যতদিন হবে ততদিন পুজো করব।” নতুন প্রজন্মের সদস্য স্মৃতিময় পাল বলেন, “আমি ছোট থেকেই এই পুজো দেখে আসছি। আমার জেঠু, বাবা, কাকারা সকলে মিলেই এই পুজো করেন। এখন থিমের পুজোর রমরমা। সেই জায়গায় আমরা পুরনো সব নিয়ম বজায় রেখেছি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.