শুভঙ্কর পাত্র: তখনও ইংরেজ ভারতে আসেনি। কোথায় রবার্ট ক্লাইভ, কোথায় বা জব চার্নক। সালটা ১৫০৭। প্রথম পুজো হয় হুগলির ‘চোদ্দ ঘর’ বসু পরিবারে (Bonedi Barir Durga Puja 2024)।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে সীতারাম বসু ঘট পুজোর মাধ্যমে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। ১৬০৫ সালে মূর্তি পুজো চালু। রঘুনাথ বসু সেই দায়িত্ব ভার নিয়ে ছিলেন।কিছু বছর পরে চাকরি সূত্রে তিনি ভদ্রকালী এলাকায় চলে যান। ফলে পুজোর আড়ম্বর কমে যায়। ১৭৪৫ সালে রামনারায়ণ বসু এই পুজো আবার মহা সমারোহে শুরু করেন। একদম প্রথম দিকে ত্রিপল খাটিয়ে ছাউনি করে পুজো করা হত। পরে মাটির মন্দির। তার পর হয় কাঠের মন্দির। তিন-চার পুরুষ আগে সিমেন্টের দালান তৈরি হয়েছে। এখন সেখানেই পুজো হয়।
ধনিয়াখালি হল্ট স্টেশন থেকে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গাড়ি করে মিনিট ১০-১৫ গেলেই ৫১৮ বছরের পুরনো ‘চোদ্দ ঘর’ বসু বাড়ির দুর্গাপুজো। গ্রামের ঢালাই রাস্তা। রাস্তার ধারে পাঁচিল ঘেরা মন্দির। ভিতরে ঢুকতেই দুটো ঘর। কিছুটা এগোলে সদর দালান। মাঝে বলির স্থান। আগে বলি হলেও এখন তা প্রায় বন্ধ। সদর দালানের পিছনে মূল মন্দির। মন্দিরের পিছনে ঘাট বাঁধানো পুকুর। টলমল করছে জল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, নীল আকাশ, তাল, নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে তাতে।
ইতিহাসের স্বাক্ষী এই পরিবারের পুজোয় রয়েছে একাধিক চমকে দেওয়ার মতো রীতি।
মহালয়ার দিনই ডাকের সাজে দেবীকে তৈরি করা হয়। এক চালার প্রতিমায় চালচিত্রে আঁকা থাকে ১০ মহাবিদ্যার ছবি। পিতৃপক্ষের অবসানের দিনই মায়ের পুজো শুরু। ঘট স্থাপনের মাধ্যমে চণ্ডীপাঠ শুরু করা হয়।
এই বাড়িতে ষোড়োপচারে পুজোর হয়। মনে করা হয় কৈলাস থেকে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মা আসেন। তাঁর পথের ক্লান্তি কাটাতে বসার জন্য আসন রেখে, পা ধুইয়ে, বস্ত্র, অলংকার, ধুনো দিয়ে দেবীর ক্লান্তি দূর করা হয়।
ষষ্ঠীতে মায়ের বোধনের পর পঞ্চপ্রদীপ, বরণ ডালা এবং চামরের বাতাসে দেবীর বরণ। সেই দিন রাতেই কলাবউ বা নবপত্রিকার স্নানের প্রস্তুতি সাড়া হয়। এখানে রয়েছে চমক।নবপত্রিকার গায়ে হলুদ করানো হয়। তার পর সপ্তমীর দিন মন্দির লাগোয়া পুকুরে পত্রিকার স্নানের পর্বটি সম্পূর্ণ হয়।
এর পরে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীর পুজো পারিবারিক নিয়ম মেনে হয়। আগে এখানে মহিষ বলি দেওয়া হত। এখন বন্ধ। কিন্তু বলির সেই খর্গ আজও অক্ষত রেখেছেন তাঁরা। নবমী ও দশমী এই দুদিন সিঁদুর খেলেন এই পরিবারের সদস্যরা।
দশমীর দিন নীলকন্ঠ ও শঙ্খচিল পাখি দেখার লক্ষ্যে পরিবারের সকলে হাঁটা শুরু করেন। কিন্তু এখন সেই পাখি দুটি প্রায় বিলুপ্ত। তাই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছে তাঁরা। দূরে অন্য একটি গ্রামের মন্দিরে বানানো হয়েছে, নীলকণ্ঠ ও শঙ্খচিলের মূর্তি। পরিবারের লোকজন ওই বানানো পাখি দুটি দেখেই বাড়িতে ফিরে আসেন।
পরিবারের সদস্য তুষারকান্তি বসু বলেন, “আমরা পুজোর নিয়মে কোনও বদল করিনি। বংশানুক্রমে চলে আসা রীতি মেনেই পুজো করা হয়। এবারও তাই হবে।পুজোর কটা দিন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়রা এক জায়গায় হই। সারা বছর এই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.