দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: প্রকৃতিকে লেন্সবন্দি করার নেশাই কাল হল। টয়ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করছিলেন। বাতাসিয়া লুপের কাছে একটা বাঁক ঘুরতে গিয়ে হালকা ঝাঁকুনি, আর তাতেই সব শেষ। দার্জিলিং ঘুরে কফিনবন্দি হয়ে রিষড়ার বাড়িতে ফিরেছেন বছর পঞ্চাশের ব্যবসায়ী প্রদীপ সাক্সেনার। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর নিথর দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। চোখের জল বাঁধ মানছে না প্রতিবেশীদেরও।
রিষড়ার বাঙ্গুর পার্কের বাসিন্দা প্রদীপ সাক্সেনা। ভ্রমণ এবং ছবি তোলা – দুটোই তাঁর বড় প্রিয়। ব্যবসা সামলে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন। পঞ্চমীর দিন স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন প্রদীপবাবু। ফেরার ট্রেন ছিল বুধবার সন্ধেবেলা, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে। ইচ্ছে ছিল, টয়ট্রেনের সফর উপভোগ করা। দুপুরের দিকে দার্জিলিং থেকে তাই টয়ট্রেন ধরে সমতল শিলিগুড়িতে নামছিলেন তাঁরা তিনজন। দু পাশের দৃশ্য তাঁকে চুম্বকের মতো টানছিল। তাকে লেন্সবন্দি করার জন্য ছটফট করছিলেন প্রদীপ সাক্সেনা। স্ত্রীর হাতে নিজের মোবাইলটি দিয়ে, চলন্ত ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরার লেন্স ঠিকঠাক করে সবে দু,একটি ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন তিনি।
এমনই সময়ে বাতাসিয়া লুপের কাছে একটি বাঁক নেয় টয়ট্রেন। একটা ঝাঁকুনি দেয় ট্রেনটি। সেই ঝাঁকুনিতেই প্রদীপবাবু পড়ে যান, পাথুরে জমিতে গড়িয়ে যায় তাঁর মাথা। ওই অবস্থাতেই তড়িঘড়ি প্রদীপবাবুকে উদ্ধার করে সোজা শিলিগুড়ির সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দেহটি ফের দার্জিলিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ময়াতদন্তের জন্য। বুধবার রাতের মধ্যেই ময়নাতদন্ত শেষ করে অ্যাম্বুল্যান্সে প্রদীপবাবুর দেহ নিয়ে রিষড়ায় রওনা হয় পরিবার। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা নাগাদ কফিনবন্দি দেহ পৌঁছায় রিষড়ার বাঙ্গুর পার্কের বাড়িতে। যদিও এদিন তাঁকে দাহ করা হবে না। আমেরিকা থেকে এক আত্মীয় আসার অপেক্ষায় দেহ থাকবে বরফচাপা দেওয়া অবস্থায়।
এলাকায় প্রদীপ সাক্সেনার মতো সৎ ব্যবসায়ী খুব কম। যেমন সুন্দর ব্যবহার, তেমনই সমস্ত কাজে তৎপর। প্রতিবেশীরা সকলেই একবাক্যে প্রদীপবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এক বয়স্কা মহিলা কাঁদতে কাঁদতেই জানাচ্ছিলেন, প্রদীপবাবুকে তিনি ভাই বলে ডাকতেন। আর ‘ভাই’ও দিদির সাহায্যে সর্বদা ছুটে যেতেন। পারমিতা মুখোপাধ্যায় নামে এক প্রতিবেশী বললেন, ‘যে কোনও সময় সমস্যায় পড়লেই, দাদার কাছে গেলে খুব সাহায্য করতেন। আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে, নিজে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতেন। এবারও রাঁচি যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছিলাম। কিন্তু আমার আত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা বাতিল করতে হয়। দাদাকে ফোন করে বলি। উনি তখন দার্জিলিংয়ে ঘুরছিলেন। সেখান থেকেই আমাকে আশ্বস্ত করেন যে টিকিট বাতিল করে টাকা ফেরত দেবেন বলে।’
এদিন দেহ বাড়িতে পৌঁছনোর পর রিষড়া পুরসভার চেয়ারম্যান বিজয়সাগর মিশ্র, হুগলির তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদব-সহ একাধিক নেতা সেখানে যান। তাঁরা প্রত্যেকেই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রয়োজনে তাঁর দেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানিয়েছেন। তবে গৃহকর্তার এমন আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবার যেন কিছুতেই ঠিক সান্ত্বনা পাচ্ছে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.