ফাইল ছবি
স্টাফ রিপোর্টার: গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে চরম টানাপোড়েনের আবহেই বঙ্গ বিজেপির অন্দরে লোকসভার টিকিট বণ্টন নিয়ে তৎপরতা তুঙ্গে। বঙ্গ ব্রিগেডের শীর্ষনেতৃত্বের একাংশের তরফে ইতিমধ্যেই সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডার কাছে রাজ্যের ৪২টি আসনের খসড়া প্রার্থীতালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকায় সবচেয়ে বড় চমক অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী।
সম্প্রতি কলকাতায় শাহ-নাড্ডার উপস্থিতিতে কোর কমিটির বৈঠকে তাঁকে দেখাই যায়নি মিঠুনকে। তবু যাদবপুরে তৃণমূলের দুর্গে ফাটল ধরাতে সেই স্বঘোষিত ‘জাত গোখরো’ মিঠুনেই ভরসা রাখতে চাইছে বাংলার গেরুয়া শিবির। সব ঠিকঠাক চললে ‘ঘরের ছেলে’ মিঠুনকে বাংলার ভোট ময়দানে দেখা যাবে এই প্রথম। আরও চমক, মেদিনীপুরে আর লড়ার সুযোগই পাচ্ছেন না বিদায়ী সাংসদ দিলীপ ঘোষ! উল্টে ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে তালিকায় রয়েছে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির নাম।
সূত্রের খবর, দিলীপ নিজে মেদিনীপুরে লড়তে চাইলেও দলের ক্ষমতাসীন সুকান্ত শিবির সেখানে তাঁর বদলে অভিনেত্রী অঞ্জনা বসুকে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে। যদিও মেদিনীপুর কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই বলে শুক্রবার নিজেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বিজেপি সাংসদ দিলীপ ঘোষ। মেদিনীপুর ছেড়ে ডায়মন্ডহারবারে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দিলীপবাবু বলেন, ‘‘ আমি কাউকে ছাড়তে চাই না, আর ছাড়ার প্রশ্নও নেই।’’ দিলীপবাবুর এই মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এদিকে শুধু দিলীপ ঘোষই নন, তালিকায় আরও বেশ কয়েকটি নামের নেপথ্যেও এমন খটকা বিস্তর। আর তার প্রেক্ষিতেই সম্ভাব্য এই প্রার্থী তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দের কাটাকুটি খেলার ছায়া কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও নজরে এসেছে বলে খবর। তাই প্রতিটি নামের ক্ষেত্রেই দফায় দফায় গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেই চূড়ান্ত সবুজ সংকেত দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।
খসড়া প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, গতবার জয়ী ১৮ সাংসদের মধ্যে এবার অন্তত তিন থেকে চারজন বাদ পড়তে পারেন। তার মধ্যে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার এবার টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা কম। মালদহ উত্তর ও রানাঘাট কেন্দ্রের বিদায়ী দুই সাংসদ খগেন মুর্মু ও জগন্নাথ সরকারের নামও খসড়া তলিকায় নেই বলেই খবর। বিদায়ী শিক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রী সুভাষ সরকারের টিকিট পাওয়াও প্রশ্নের মুখে। আবার লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো দু’একজনের কেন্দ্র বদলের সম্ভাবনা প্রবল। কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ও জন বার্লা এবারও লড়বেন। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে যথারীতি টিকিট পাচ্ছেন জয়ন্ত রায় ও দেবশ্রী চৌধুরি। দার্জিলিং কেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থী নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা চরমে উঠেছে। ইন্ডিয়া জোটের তরফে কংগ্রেস প্রার্থীই এই আসনে লড়বেন নাকি সর্বসম্মত কোনও প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তা নিয়ে সিদ্ধান্ত এখনও অনিশ্চিত। তবে গেরুয়া ব্রিগেড এই আসনে এবারও বিদায়ী সাংসদ রাজু বিস্তার উপরই ভরসা রাখতে তৈরি। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবারও বালুরঘাট থেকেই লড়বেন। তবে মালদহ উত্তর ও দক্ষিণ দুই কেন্দ্রেই গেরুয়া ব্রিগেডের প্রার্থী আপাতত অনিশ্চিত। কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের জল শেষপর্যন্ত কোন খাতে গড়ায় এবং সেক্ষেত্রে বামেদের ভূমিকাই বা কী দাঁড়ায়, তা দেখেই বিজেপি এই দুই কেন্দ্রে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। খাসতালুক পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রার্থী হওয়াও এখনও নিশ্চিত নয়। বিকল্প হিসাবে এখানে শুভেন্দুর ছোট ভাই সৌমেন্দু অধিকারীর নাম রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই কেন্দ্রে গেরুয়া ব্রিগেডের প্রার্থীর নাম একেবারে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত করা হতে পারে বলেও একটি সূত্রের খবর। বিদায়ী সাংসদ দিবে্যন্দু অধিকারীই দল বদলে এবার তমলুক আসনে বিজেপির প্রার্থী হতে চলেছেন। মেদিনীপুরে বিদায়ী সাংসদ দিলীপ ঘোষের বিকল্প প্রার্থী দাঁড় করানো ছাড়া পশ্চিম মেদিনীপুর ও ও ঝাড়গ্রামে বিজেপির সম্ভাব্য তালিকায় আপাতত আর কোনও চমক নেই। ঘাটালে যথারীতি লড়বেন ভারতী ঘোষ আর ঝাড়গ্রামে এবারও টিকিট পাচ্ছেন বিদায়ী সাংসদ কুনার হেমব্রম।
অঞ্জনা বসুর পাশাপাশি রুপোলি পর্দার আর এক নায়িকা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কেও এবার লোকসভার লড়াইয়ের ময়দানে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। গেরুয়া ব্রিগেডেরই রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন রূপা। তাঁকে বারাসত কেন্দ্র থেকে দাঁড় করাতে চাইছেন বঙ্গ বিজেপির শীর্ষনেতারা। তিনি একান্তই রাজি না হলে বারাসত থেকে বিজেপির টিকিটে লড়বেন অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ। গেরুয়া শিবিরের আর এক অভিনেত্রী-সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়েরও টিকিট নিশ্চিত। তবে নিজের হুগলি কেন্দ্রের বদলে লকেট এবার বাঁকুড়া থেকে লড়তে বেশি আগ্রহী। তবে লকেট বাঁকুড়া থেকেই প্রার্থী হলে বিদায়ী সাংসদ তথা মন্ত্রী ডা. সুভাষ সরকারের ভবিষ্যৎ আপাতত অনিশ্চিত। হুগলির আরামবাগ কেন্দ্র থেকে লড়বেন মধুসূদন বাগ। বিষ্ণুপুর ও পুরুলিয়া কেন্দ্র থেকে এবারও গেরুয়া শিবিরের টিকিট পেতে চলেছেন সৌমিত্র খাঁ ও জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার আর টিকিট না পাওয়া একরকম নিশ্চিতই। বর্ষীয়ান এই নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী অবশ্য তদ্বির অব্যাহত রেখেছেন। যদিও তাতে চিঁডে় না ভেজার সম্ভাবনাই প্রবল বলে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। বর্ধমান-দুর্গাপুর ও পাশের আসানসোল কেন্দ্রে বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে কেয়া ঘোষ ও অগ্নিমিত্রা পালের নাম কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে জমা পড়েছে। আর বর্ধমান পূর্ব আসনে লড়বেন পরেশচন্দ্র দাস।
অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডলের বিরুদ্ধে একা কুম্ভ হিসাবে দাঁড়িয়ে একসময় গেরুয়া শিবিরকে বিস্তর অক্সিজেন জুগিয়েছেন। তারপর দলের সঙ্গে মতান্তরে সব ছেড়েছুড়ে আড়ালে চলে যাওয়ার পর ইদানীং বীরভূমে ফের সক্রিয় বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল। বীরভূমে ডাকাবুকো শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে সেই দুধকুমারকেই প্রার্থী করতে চলেছে বিজেপি। বোলপুরে গেরুয়া শিবিরের বাজি কে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। মালদহের ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরিই রাজ্যের একমাত্র বিধায়ক, যাঁকে সরাসরি সাংসদ পদে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড। সেই টার্গেটেই মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে এবার লোকসভার সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে তালিকায় শ্রীরূপার নাম রাখা হয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের সময় থেকেই মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রীতিমতো দাপিয়ে বেড়ানো নেত্রী মাফুজা খাতুনকে এবার বহরমপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী করতে চলেছে বিজেপি। অধীর চৌধুরির বিরুদ্ধে ময়দানে মাফুজার উপস্থিতি লড়াইয়ে অন্য মাত্রা এনে দেবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে বিজেপির সম্ভাব্য প্রার্থী হতে চলেছেন মোহন হালদার। উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে বিজেপির এবারের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে তালিকায় তরুণ নেতা সজল ঘোষের নাম রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতায় পদ্ম প্রতীকে কে লড়বেন, তা অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয়।
নদিয়ার দুটি কেন্দ্রেই এবার প্রার্থী বাচাইয়ে চমক দিতে চলেছে গেরুয়া শিবির। সদ্য সংসদ থেকে বহিষ্কৃত তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের কৃষ্ণনগরে ফের প্রার্থী হওয়া একরকম নিশ্চিত। তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্যোর সদ্য প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কেই বাজি বিজেপির। প্রসঙ্গত, সৌমেন্দ্রনাথবাবুর বাবা সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় এই কেন্দ্র থেকেই বিজেপির টিকিটে জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন। আবার সম্প্রতি অ্যাডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সময় রাজ্যকে দুষে সৌমেন্দ্রনাথ রীতিমতো শিরোনামে আসেন। এই প্রেক্ষিতে তাঁর বিজেপির টিকিটে লড়াই রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিদায়ী সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে আর রানাঘাট কেন্দ্র থেকে বিজেপি মনোনয়ন দিচ্ছে না বলেই জানা গিয়েছে। সম্ভাব্য তালিকায় তাঁর পরিবর্তে রানাঘাটে প্রার্থী হিসাবে অর্চনা মজুমদারের নাম রয়েছে বলে খবর। তবে তালিকায় নাম থাকলেও সবকটি ক্ষেত্রেই যে তা নিশ্চিত, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। সৌজন্যে বিজেপির বেআব্রু হয়ে পড়া গোষ্ঠীকলহের সমীকরণ। শ্রীরামপুরে পরিস্থিতি ঠিক এই কারণেই জটিল হয়ে রয়েছে। দলের আইনজীবী নেতা দেবজিৎ সরকারের নাম এই কেন্দ্রে রাজ্রযে শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ চূড়ান্ত করলেও শুভেন্দু গোষ্ঠী এখানে মধুছন্দা করকে দাঁড় করাতেই বেশি আগ্রহী। কার ভাগ্যে শেষমেশ শিকে ছিঁড়বে তা এখনও অনিশ্চিত। বসিরহাটেও টানাপোড়েন তুঙ্গে। দলের প্রাক্তন বিধায়ক তথা অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বসিরহাট থেকে লড়ার কথা। খসড়া তলিকায় ইঙ্গিত তেমনই। কিন্তু সূত্রের খবর, অভিনেতা জয় বন্দ্যেোপাধ্যায় এই আসনেই টিকিট পেতে রীতিমতো তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই দৌড়ে জিত কার হয়, নজর থাকবে সেদিকেই। বনগাঁয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এবারও টিকিট পাচ্ছেন। তবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাকি সব আসনেই এবার নতুন মুখে ভরসা করতে চলেছে বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড। বারাকপুর ও দমদমে সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছে মোট চারটি নাম। বারাকপুরে লড়তে পারেন বিপ্লব মিত্র বা মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দমদমে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহার পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে রিমঝিম ঘোষেরও নাম রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে মোহন সরকার ও মথুরাপুরে দিলীপ জাটুয়াকে প্রার্থী করতে চলেছে বিজেপি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.