ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য,পুরুলিয়া: চড়া রোদ। দুপুর একটা। রাস্তা-ঘাট শুনশান।সকালের দিকে অন্যরকম ছিল। রাস্তা, বাজার বেশ গমগম করছিল। কিন্তু দশটা বাজতে না বাজতেই বেমালুম ফাঁকা। গাড়িতে রাখা তাপমাপার যন্ত্রে দেখা গেল, অযোধ্যা পাহাড়ের আপার ড্যাম সংলগ্ন এলাকার তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রির আশপাশে। এতটাই গরম হাওয়া যে চামড়া পুড়িয়ে দেয়।
সুইসা আশ্রম (যেখানে শায়িত রাজ্য বামফ্রন্টের অন্যতম কারিগর অশোক ঘোষ) থেকে এই অযোধ্যা পাহাড় পর্যন্ত প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু একটাও সিপিএম বা ফরোয়ার্ড ব্লকের দলীয় কার্যালয় চোখে পড়ল না। চোখে পড়ল না কংগ্রেসের কোনও পার্টি আফিসও। তৃণমূলের একটা অফিস ছিল ঠিকই, কিন্তু ঝাঁপ বন্ধ। তবে ইতিমধ্যেই অন্তত গোটা পাঁচেক বিজেপির কার্যালয় দেখা গিয়েছে। তীব্র গরম উপেক্ষা করে দলে দলে লোক আসছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর দলীয় সভা। সব মণ্ডলের কর্মীরাই চান তাঁদের এলাকা থেকে বেশি লোক জমায়েত করতে। ঘটনা হল, এখন যাঁরা বিজেপির কর্মী বা সমর্থক, তাঁরা সবাই কিন্তু নরহরিপন্থী। অর্থাৎ প্রাক্তন সাংসদ নরহরির মাহাতোর সঙ্গে সিংহর গুহা ছেড়ে পদ্ম শিবিরে ঘাঁটি গেড়েছেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাম শিবির জনমানবহীন। আর গমগম করছে বিজেপির ঘর। উত্তর বা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএমের যে অবস্থা, এখানেও তাই। বাগমুণ্ডি মণ্ডল কমিটির আহ্বায়ক জগদীশ কুমারের সাফ কথা, ‘পুরুলিয়ায় আমাদের লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে। ওসব ফরোয়ার্ড ব্লক-টক কিচ্ছু না।’ নরেন চট্টোপাধ্যায় ও দলের নেতাদের এহেন বক্তব্য শুনে গোঁসা হতে পারে। কিন্তু এটাই ঘটনা।
এখানে মনে রাখা দরকার, পুরুলিয়া জেলায় গেরুয়া শিবিরের বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ – ফরোয়ার্ড ব্লক ও নরহরির মতো কিছু প্রথম সারির নেতা। বিজেপির আরেক জেলা নেতা বীরেন সিংহ সরকারি ঠিকাদার। তবে রাজনীতি ছাড়া থাকতে পারেন না। তিনি প্রথমে ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক, তারপর তৃণমূল, আর এখন লোকসভা ভোটের আগে পদ্ম শিবিরে ঢুকেই জেলা নেতার মর্যাদা পেয়েছেন। বললেন, ‘অশোক ঘোষ যতদিন ছিলেন দলে মান-সম্মান ছিল। তারপর তৃণমূলে গেলাম। কিন্তু যোগ্য জায়গা পেলাম না। তাই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেছি। তিন মাসের মধ্যে জেলা কমিটিতে ঢুকেছি। প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় আমরা অন্তত আট হাজার লোক নিয়ে যাব।’
রুক্ষ পাথুরে জমির জেলা পুরুলিয়া একটা সময় ছিল ‘লাল দুর্গ’। সেসব এখন ইতিহাস। তবে গত পঞ্চায়েতের পর একটা অন্যরকম বদলের ইঙ্গিত মিলেছিল। ফরোয়ার্ড ব্লক প্রার্থী বীরসিং মাহাতোর কথায়, “ঘাসফুলের মাঝে পদ্মফুল ফুটতে শুরু করেছে। আর এটাই এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। এবার পুরুলিয়ার যা অবস্থা, তাতে কেউ খুব একটা স্বস্তিতে নেই। এমন কঠিন লড়াই কোনওদিন হয়নি।” অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর। অশীতিপর বীরসিংবাবু এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অনুরোধে। “বিমান বসু বাড়ি এসে অনুরোধ করলেন, তাই দাঁড়াতে হল”, বললেন তিনি। আগামী ১২ মে প্রার্থীদের সকলের ভাগ্য নির্ধারণ৷
কংগ্রেসেরও একই অবস্থা। একটা কথা চালু আছে প্রদেশে কংগ্রেসে, দলের দুঃসময়ে কেউ না থাকুক, নেপাল মাহাতো আছেন। তাই এই সময়ে জেলার দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন রাজ্য নেতারা। দু’বেলা চড়া রোদে প্রচার করেও মন ভাল নেই বিধায়কের। বললেন, “অস্বীকার করব না, জেলায় কংগ্রেসের সংগঠনের হাল ভাল নয়। সিপিএমেরও বেহাল দশা। এবার কী হবে, বলা খুব মুশকিল।”
পুরুলিয়া জেলার অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ মাহাতো। স্বাধীনতার আগে থেকেই জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন মাহাতোরা। বাকি তফসিলি ও আদিবাসীরা। অযোধ্যা পাহাড়ের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও পরিবেশ নিয়ে কয়েক মাস ধরে অশান্তি চলছে। এই ঘটনায় অভিযোগের তির বিজেপির দিকে। তবে পুরুলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে প্রচুর টুরিস্ট স্পট গড়ে উঠেছে। এলাকায় কর্মসংস্থান হয়েছে। কাজ পেয়েছেন বেকার যুবক-যুবতীরা। ঘাসফুল তাই তাজা। কিন্তু তার পরেও পদ্মকুঁড়ি চোখে পড়ছে অনেকেরই। সেই কুঁড়ি ফুটে ফুল হবে কি না, ২৩ মে’র আগে বলা কঠিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.