ব্রতদীপ ভট্টাচার্য, সন্দেশখালি: মার, পালটা মার। তিনজনের জীবনান্ত, একজন নিরুদ্দেশ। জখম প্রচুর। হতাহতের রাজনৈতিক পরিচয় আনুগত্য নিয়ে শাসক-বিরোধী চাপানউতোর, রাজ্য-জাতীয়স্তরে তুঙ্গে তরজা। দেহ সৎকার নিয়েও তুমুল অশান্তি।সন্দেশখালিকাণ্ড ঘিরে গত তিন দিনের উত্তেজক ঘটনাপ্রবাহে রাজ্য সরগরম। যদিও দোষীদের বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ অর্থাৎ এফআইআর টুকুও রবিবার পর্যন্ত দায়ের হয়নি। অবশেষে সোমবার দুপুরে নিহতদের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে সন্দেশখালি থানার পুলিশ তিনটি খুনের মামলা রুজু করে।
এফআইআরে সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহাজাহানকে যেমন অভিযুক্ত করা হয়েছে। তেমনই রয়েছে তৃণমূলের আরও ২৫ জনের নাম। অভিযোগের তালিকায় আছেন বিজেপির ২৬ কর্মী। এমনকী নিহত দুই বিজেপি কর্মী প্রদীপ ও সুকান্ত মণ্ডলও সেই তালিকা থেকে বাদ যাননি। যা দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অন্যদিকে, সন্দেশখালি নিয়ে দিল্লির তরফেও তৎপরতা নজরে পড়েছে। এদিন সকালে সন্দেশখালির ভাঙ্গিপাড়ায় যান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একটি দল। গ্রামে ঘুরে ঘটনাস্থলের ভিডিওগ্রাফি করেন তাঁরা। যে ভেড়িতে বিজেপি কর্মীদের ধাওয়া করে খুন করা হয়েছে, সেটিও ঘুরে দেখেন তাঁরা।
জানা যায়, জেলা পুলিশের থেকে এবিষয়ে তথ্য নিয়েছেন এই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর থেকে সন্দেশখালির ভাঙ্গিপাড়া গ্রামে রাজনৈতিক রেষারেষির যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল, শনিবার দুপুরে তা চরম আকার ধারণ করে। বিজেপি ও তৃণমূলের সংঘর্ষে প্রাণ যায় তিনজনের। দুই বিজেপি কর্মী প্রদীপ মণ্ডল ও সুকান্ত মণ্ডলকে গুলি করে খুন করা হয়। মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু হয় কায়ুম আলি মোল্লা নামে এক তৃণমূল কর্মীরও। ঘটনার পর সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যার নেপথ্য নায়ক হিসাবে সন্দেশখালির ‘বাদশাহ’ শেখ শাজাহানের নাম উঠে আসে বারবার। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে বিজেপি নেতৃত্ব, প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন, শনিবার এই হামলাটি চালানো হয়েছে শেখ শাজাহানের নির্দেশেই। দু’দিন জোর চাপানউতোর চলে এই ঘটনাকে ঘিরে। অবশেষে সোমবার শাজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয় সন্দেশখালি থানায়।
পুলিশ সূত্রে খবর, নিহত বিজেপি কর্মী প্রদীপ মণ্ডলের স্ত্রী পদ্মা মণ্ডল থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। স্বামী প্রদীপ-সহ খুড়তুতো দেওর সুকান্তর হত্যার জন্য সন্দেশখালি ব্লকের সভাপতি শেখ শাজাহানকে দায়ী করেছেন তিনি। একই সঙ্গে আরও ২৫জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেছেন। সূত্রের খবর, তার মধ্যে নাম রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ ফিরোজ কামাল গাজি ওরফে বাবু মাস্টার ও স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কাদের আলি মোল্লারও। অন্যদিকে, নিহত তৃণমূল কর্মী কায়ুম মোল্লার পরিবারের তরফ থেকেই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সন্দেশখালি থানায়। তাতে মৃত প্রদীপ মণ্ডল ও সুকান্ত মণ্ডল-সহ ২৬ জন বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে কায়ুমকে হত্যার অভিযোগ তুলেছেন।
তবে সন্দেশখালিকাণ্ডের যাবতীয় অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটিই চরিত্র, ওই এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’ শাহাজাহান শেখ। সব জমানাতেই যে পেশিশক্তি দিয়ে নিজের গড় অক্ষুন্ন রেখেছে বলে মত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের। এক সময় বামেদের দলে থেকে রাজত্ব করেছেন সেখানে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর তৃণমূলে নাম লেখান তিনি। সন্দেশখালির প্রবাদ, শাহাজাহানের অনুমতি ছাড়া সন্দেশখালিতে গাছের একটা পাতাও নড়ে না। মৃত বিজেপি কর্মীদের পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, বিজেপি করার জন্য শাজাহানের লোকেরা প্রায়ই হুমকি দিত। ভোটের আগেও তার লোকেরা বিজেপি সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে গিয়েছিল, যাতে কেউ ভোট না দিতে যায়। লোকসভা নির্বাচনে ভাঙ্গিপাড়ায় প্রদীপ ও সুকান্তর জন্য বিজেপি ওই বুথে লিড পায়। তাই শাজাহান তাদের পরিকল্পনা করে খুন করিয়ে দেয়।
গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তুলছেন, এফআইআর করেও কি আদৌ শাজাহানকে বাগে আনা যাবে? তাঁদের অভিযোগ, ওই এলাকার পুলিশ শাহাজাহানের কথায় ওঠে আর বসে। তাঁদের আশঙ্কা, গ্রাম থেকে পুলিশ চলে গেলেই ফের হামলা করবে শাহাজাহানের বাহিনী।
শাহাজাহানের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে বিজেপি নেতা মুকুল রায় বলেন, “বাংলাদেশিদের নিয়ে সন্দেশখালিতে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে শাহাজাহান। এফআইআর হওয়ার পর ও বাংলাদেশ পালিয়ে যাবে।” সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “শাহাজাহান সীমান্ত কবজা করে রেখেছে। সন্দেশখালিতে বিরোধী শূন্য করতে চাইছে।” এবিষয়ে বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা হুঁশিয়ারির সূরে বলেন, “শাহাজাহান, বাবু মাস্টার, এরা না শোধরালে তাদের কপালে চরম দুঃখ আছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামো আইন অনুযায়ী যা করার করবে।” তিনি আরও জানান, মৃতদের মধ্যে তফসিলি জাতি, উপজাতির অনেকে আছেন, তাই এসসিএসটি কমিশনেও নালিশ জানানো হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.