সৌরভ মাজি, বর্ধমান: দুধ তরল হলেও, ছানাই হল সহজপাচ্য৷ রোগীকে তাই দুধ নয়, ছানা খাওয়ানোর বিধান দেন চিকিৎসকরা৷ রসায়ন বিজ্ঞানের ভাষায়, কেজিন থেকে কেজিনোজেনে রূপান্তরই হল দুধ থেকে ছানা৷ সাধারণভাবে দুধে জাল দিয়ে তাতে লেবুর রস দিলেই ছানা তৈরি৷ কিন্তু দুধ নষ্ট হয়ে গিয়ে যে ছানা তৈরি হয় তা না লাগে হোমে, না যজ্ঞে৷ তাই দুধকে সযত্নে রাখতে মরিয়া ব্যবসায়ীরা৷ কারণ ওটাই তো রুটিরুজির রাস্তা৷ কুইণ্টাল কুইণ্টাল ছানা যেখানে তৈরি হয়, তখন আর লেবুর রসে ছানা তৈরির পথে যান না বেশিরভাগ ব্যবসায়ী৷ ‘দুধ কাটা’র জন্য অনেকে অনেক পন্থা নেন, কিন্তু সাম্প্রতিককালে ছানা ব্যবসায়ীরা যা ব্যবহার করছেন, তা ক্ষতিকারক৷ সংবাদ প্রতিদিনের অন্তর্তদন্তে উঠে এল এমনই কিছু তথ্য।
[ফেলো কড়ি নাও ডিগ্রি, ভুয়ো কলেজের ফাঁদ জেলায় জেলায়]
এক ফোঁটাতেই কাজ শেষ
বেশ কিছু গোয়ালা বা মিষ্টি ব্যবসায়ী গরম দুধে মেশান ক্যালসিয়াম ল্যাকটোজ৷ যা অল্প ক্ষতিকারক হলেও, দুধে মিশে থাকা ‘মিল্ক অ্যান্টিফাংগাস অ্যাসিড’-এর সঙ্গে মিশে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে৷ ‘মিল্ক অ্যান্টিফাংগাস অ্যাসিড’ এর ব্যবহারে দুধ বা ছানা যাতে দীর্ঘক্ষণ ভাল থাকে। এবং এর কার্যকারিতাও মারাত্মক। ৩০ লিটার দুধে মাত্র এক ফোঁটা এই কেমিক্যাল দিলেই দুধ ও ছানা নষ্ট হবে না অন্তত ৪৮ ঘণ্টা৷ কিন্তু কেন এই পথে হাঁটছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা? তার খোঁজ নিতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে।
[সস্তায় ২০ হাজারে বাইক কিনেছেন? ঠিকানা হতে পারে শ্রীঘর]
ছানার রাজ্যে অসাধুদের বাড়বাড়ন্ত
ভাগীরথী লাগোয়া পূর্বস্থলীর ছানার বাংলাজোড়া নাম৷ পূর্বস্থলী ছাড়াও কালনা, কাটোয়া-সহ গোটা পূর্ব বর্ধমান জেলা থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার লিটার দুধ ও প্রায় ৫০ কুইন্টাল ছানা রপ্তানি হয় বীরভূম, নদিয়া, কলকাতা, উত্তরবঙ্গে এমনকী বিহার, ঝাড়খণ্ডে৷ এখানে ছানার ব্যবসার এতটাই রমরমা যে রাজ্য সরকার এলাকার দুধ ও ছানা ব্যবসায়ীদের ন্যায্য মূল্যে দুধ কেনার জন্য কান্দিতে ভাগীরথী দুগ্ধ সমবায় সমিতি তৈরি করেছে৷ কিন্তু সেখানে বিক্রেতা নেই৷ কারণ কান্দিতে দুধে ভেজাল এবং কেমিক্যাল পরীক্ষা করে নেওয়া হয়৷ তাই বেশিরভাগ (ঘোষ) দুধ ব্যবসায়ী কেমিক্যাল দিয়ে দুধ বাইরে পাঠিয়ে দেন৷ তার মানে এটা পরিষ্কার দুধ বা ছানা ঠিক রাখতে ব্যবসায়ীরা যে রাসায়নিক পদার্থ দিচ্ছেন তা ক্ষতিকারক৷ কিছুদিন আগে কেমিক্যাল মেশানো দুধ খেয়ে দুই শিশু পনেরো দিন একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। দুধের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় পরীক্ষায়৷ অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুধ বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানালেন ফরাক্কার বিডিও কেশাঙ্গ ডেন্ডুপ ভুটিয়া৷ সেই দুধ কান্দি থেকে যায়নি হলফ করে কে বলতে পারে?
[ আলুতে দেদারে মিশছে বিষাক্ত রং, বুঝবেন কীভাবে? ]
প্রাণঘাতী অ্যান্টিফাংগাস অ্যাসিড
‘মিল্ক অ্যান্টিফাংগাস অ্যাসিড’ কতটা বিষাক্ত? চিকিৎসকরা বলছেন, এতটাই বিষাক্ত আত্মহত্যার জন্যও মাত্র দু’ফোঁটা যথেষ্ট৷ ওই রাসায়নিক খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে৷ চোরা বাজার থেকে এই বোতল কিনে প্রথমে তাকে জলে দীর্ঘক্ষণ ডুবিয়ে গায়ের লেবেল তুলে ফেলা হয়৷ ফলে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না বোতলে মারাত্মক কোনও রাসায়নিক রয়েছে, নাকি সাধারণ জল৷ যদিও এই কেমিক্যাল নিয়ে কোনও দুধ ও ছানা ব্যবসায়ী মুখ খুলতে নারাজ৷ তবে ছোট, বড়, মাঝারি সকল দুধ, ছানা ব্যবসায়ী খোঁজ রাখেন কোথায় পাওয়া যায় ও কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এই কেমিক্যাল৷ কতটা দুধে কেমিক্যাল কতটা মেশানো প্রয়োজন৷ ভাতারের স্বপন ঘোষ, মধু ঘোষদের কথায়, “ওই কেমিক্যাল কান্দি বাসস্ট্যান্ডের দুটো ওষুধের দোকানে মেলে৷ খুব পরিচিত ছাড়া ওরা দেয় না৷ ওটা অ্যাসিড৷ ৩০ লিটার দুধে এক ফোঁটা দিলেই ৪৮ ঘণ্টা ছানা তরতাজা থাকবে। মানুষ খালি পেটে ৫ ফোঁটা খেলেই মৃত্যু অনিবার্য৷ আমরা ব্যবহার করি না৷ ছানাতেও এক ফোঁটা দিলে ছানা নষ্ট হবে না৷ নরম থাকবে৷ মনে হবে টাটকা৷ তবে বাচ্চাদের পেটে গেলে বমি, পেট ব্যথা, জ্বর হবে৷”
[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]
বর্ধমানে এতবড় ছানা ব্যবসায় এই মারাত্মক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। ছানা ব্যবসায়ীদের একাংশ তা মেনেও নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ থেকে একটু সচেতন বাসিন্দা সে খবর জানেন, অথচ প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? অনেকেরই দাবি, প্রশাসন সব জানে৷ কিন্তু অসাধু ছানা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের অদ্ভুত বোঝাপড়া রয়েছে৷ তাই দেখেও দেখে না কেউ৷ আর ফরাক্কার মতো ঘটনা ঘটলে তখন নড়াচড়া শুরু হয়৷ যদিও পুলিশের কর্তারা বলেন, “আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না৷ খোঁজখবর নেব৷”
[ মোটা মাইনের ফাঁদ, ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে কৈশোর কাটছে ক্রীতদাস হয়ে ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.