সুমিত বিশ্বাস ও সৌরভ মাজি: মাওবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নয় সহকর্মীর গুলিতে প্রাণ গিয়েছে পুরুলিয়া এবং বর্ধমানের দুই আইটিবিপি জওয়ানের। পুরুলিয়ার বিশ্বরূপ মাহাতো এবং বর্ধমানের সুরজিতের মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারছেন না তাঁর পরিজন-প্রতিবেশীরা। এভাবে যে ছেলে চলে যেতে পারে, তা যেন দুঃস্বপ্নের চেয়েও কঠিন। তাঁদের কফিনবন্দি দেহের অপেক্ষাতেই সময় কাটছে নিহতের পরিজনদের।
মাও দমনে জঙ্গল যুদ্ধে গিয়ে বন্ধুই যে ‘শত্রু’ হয়ে যাবে তা যেন ভাবতেই পারছে না তার পরিবার! এই তো চার-পাঁচ দিন আগেও শিবিরে থাকা সহকর্মীদের নিয়ে তাঁর মায়ের কাছে কত গল্প করছিলেন বিশ্বরূপ। গত সোমবারও ছত্তিশগড়ের কাদেনার ক্যাম্প থেকে ভিডিও কল করে সেখানকার শিবিরের কত কথা বলছিলেন। আর বুধবার দুপুরে তার পরিবারকে শুনতে হল ওই ক্যাম্পেই তার সহকর্মীর আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে বিশ্বরূপ মাহাতো (২৭)–র মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই সহকর্মী সহ মোট ছ’জন মারা যান। জখম হন আরও দুই সহকর্মী। এদিন আড়শা থানা থেকে এক সিভিক ভলান্টিয়ার তাদের আড়শার খুকরামুড়ার বাড়িতে এই খবর দিয়ে যান। তারপর থেকেই গোটা গ্রাম যেন এই বাড়িতেই আছড়ে পড়ে।
হতবাক নিহত বিশ্বরূপের পরিবারও। তাঁর বাবা প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ভীমচন্দ্র মাহাতোও বাকরুদ্ধ। কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। আর মা ভাগ্য মাহাতো জমিতে ধান কাটার সময় খবর পাওয়ার পর থেকে শুধুই কাঁদছেন। তিনি বলেন, “মাও দমনে জঙ্গল যুদ্ধে গিয়ে সহকর্মীর হাতে যে ছেলেটার মৃত্যু হবে তা ভাবতেই পারছি না। এই তো ক’দিন আগেই ক্যাম্পের কত কথা বলল।” কাঁদতে কাঁদতে কথা আটকে যায় ভাগ্য দেবীর। মাও দমনে এই বাহিনীর ৪৫ নম্বর ব্যাটেলিয়নের জওয়ানদের এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেন নিহত জওয়ানের বড়দা আশিস মাহাতো। তিনি বলেন, “কেন এই ঘটনা ঘটল। এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করছি আমরা। এভাবে ভাইকে মেরে ফেলল!” চোখে জল চলে আসে তাঁরও। লাজুক বিশ্বরূপ একাধিক ধাপ পার হয়ে ২০১৪ সালে এই বাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম পোস্টিং রাজস্থানের যোধপুরে। একবছর আগে তিনি ছত্তিশগড়ের ক্যাম্পে আসেন। তাঁর মেজদা সুবোধ মাহাতোও জুনিয়র কনস্টেবল। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় কর্মরত। ফলে দেশকে বাঁচাতে শত্রুকে কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা তাদের মজ্জায় রয়েছে। কিন্তু সহকর্মীর হাতেই এমন পরিণতিতে হতবাক খুকরামুড়ার প্রত্যেকে।
এই একই দুঃসংবাদের জেরে পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী-১ ব্লকের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামের ঘোষপাড়ার সুরজিৎ সরকারের বাড়ির ছবিও ঠিক একইরকম। সুরজিতের পরিবারের কেউই কার্যত কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। বছর পাঁচেক আগে আইটিবিপিতে চাকরি পান সুরজিৎ। নতুন বাড়িও তৈরি করছিলেন তিনি। তাঁর বাবা পীযূষ সরকার পেশায় তন্তুবায়। তিনি জানান, নাদনঘাট থানা থেকে এক সিভিক ভলান্টিয়ার এসেছিলেন। তাঁদের ঠিকানা-সহ বিস্তারিত তথ্য নিয়ে যান। কেন জানতে চাইলে সিভিক তাঁদের প্রথমে কিছু বলতে পারেননি। সসংকোচে জানান, টিভিতে খবর দেখার জন্য। টিভি খুলেই শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন পরিবারের লোকজন। মা পার্বতীদেবী ও দিদি পিঙ্কি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক বন্ধু বাপ্পা দে জানান, ভাইফোঁটার সময় এসেছিলেন সুরজিৎ। রাস পর্যন্ত ছিলেন। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা মারেন। সে যে এমন অসময়ে চলে যাবে, তা ভাবতে পারেননি কেউই। কফিনবন্দি নিহত জওয়ানদের অপেক্ষায় বিশ্বরূপ এবং সুরজিতের পরিজন-প্রতিবেশীরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.