গৌতম ব্রহ্ম: উইসকনসেন দ্রবণে রাখা কিডনি নিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে পিজির দিকে যখন দৌড় লাগাল অ্যাম্বুল্যান্স, তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল ইতিহাস৷
ঘড়িতে তখন রাত ১২.৫৮৷ অ্যম্বুল্যান্সের সামনে পিছনে কলকাতা পুলিশের পাইলট কার৷ ‘গ্রিন করিডর’ ধরে ছুটছে বসিরহাটের বাসিন্দা স্বর্ণেন্দু রায়ের কিডনি৷ ১৮ কিমি রাস্তা পেরোতে মাত্র এগারো মিনিট সময় লেগেছিল৷
এই ঘটনা এখন সবার জানা৷ কিন্তু এই ইতিহাস তৈরির পিছনে ছিল ১২ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটের একটা ‘যুদ্ধ’৷ সমন্বয়ের অভূতপূর্ব ইন্দ্রজাল৷ স্বাস্থ্যভবন, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ফুলবাগান থানা, লালবাজার, এনআরএস হাসপাতালের মর্গ, পিজি হাসপাতাল, এথিক্যাল কমিটি৷ সবাই একজোট হয়ে জন্ম দিয়েছে রাজ্যের প্রথম সবুজ সরণির৷ বাংলার এই ‘গ্রিন করিডর’ মডেলই অঙ্গদানের ক্ষেত্রে দেশ অনুসরণ করবে বলে জানিয়ে দিল ‘ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লাণ্ট অর্গানাইজেশন’৷ সোমবার ছত্তিশগড় থেকে ফোন করে গোটা বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছে৷
ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটা নাগাদ৷ স্বাস্থ্যভবনে একটি বৈঠক করছিলেন অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (প্রশাসন) ডা. অদিতিকিশোর সরকার৷ অদিতিবাবু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সিনিয়র নোডাল অফিসার’৷ অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল অধিকর্তা সুজয় কর অদিতিবাবুকে ফোন করে ‘ব্রেন ডেথ’ ও অঙ্গদানের বিষয়টি জানান৷ অদিতিবাবু একমুহূর্ত দেরি করেননি৷ সুজয়বাবুকে জানিয়ে দেন, “চার সদস্যের কমিটি তৈরি রাখুন৷ আমি দ্রুত পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছি অ্যাপোলোয়৷” আধঘণ্টার মধ্যে অ্যাপোলোতে গিয়ে স্বর্ণেন্দুর ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণায় সিলমোহর দেন অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ডিরেক্টর পদমর্যাদার ওই চিকিৎসক৷
এরপর অদিতিবাবু ফোন করেন ফুলবাগান থানার আইসি পীযূষ কুণ্ডুকে৷ যেহেতু পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল স্বর্ণেন্দুর৷ তাই ময়নাতদন্ত ছিল বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু ময়নাতদন্তের আগেই যে স্বর্ণেন্দুকে কাঁটাছেড়া করতে হবে৷ শরীর থেকে বের করে নিতে হবে কিডনি, লিভার ও চোখ৷ বিষয়টি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে না জানালে তো অনর্থ ঘটে যাবে৷ পীযূষবাবুর থেকে অদিতিবাবু জানতে পারেন স্বর্ণেন্দুর দেহের ময়নাতদন্ত হবে এনআরএসে৷ অদিতিবাবু এরপর ফোন করেন এনআরএসের এমএসভিপি ডা. মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ বিষয়টি জানান৷ মণিময়বাবু অটোপসি সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে ছাড়পত্র আদায় করেন৷ এরপর শুরু হয় সবুজ সরণি তৈরির পালা৷
অদিতিবাবু ফোন করেন কলকাতা পুলিশের ডিসি ট্রাফিক এস নিশা কুমারকে৷ ‘গ্রিন করিডর’ তৈরির আবেদন জানান৷ অদিতিবাবু জানিয়েছেন, “নিশা কুমার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেলেন৷ জানেন দ্রুততার জন্য ই-মেলের পরিবর্তে বেশ কয়েকটি অনুমতি এসএমএসে সারতে হয়েছে?” এখানেই শেষ নয়৷ স্বর্ণেন্দুর শরীর থেকে লিভার বের করা ও তা প্রতিস্থাপনের জন্য দিল্লি থেকে উড়িয়ে আনা হয় ডা. সুভাষ গুপ্তাকে৷ সুভাষবাবুই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ৩ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘কাস্টডিয়াল সলিউশন’৷ এই তরলে ডুবিয়েই অ্যাপোলো থেকে লিভার নিয়ে যাওয়া হয় পিজিতে৷ দ্রুততার সঙ্গে সেই টাকারও ব্যবস্থা হয়ে যায়৷ তিনি স্বীকার করে নেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে নবান্ন ও স্বাস্থ্য দফতর তাঁকে কার্যত ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিয়ে দিয়েছিল৷ তাই এত দ্রুততার সঙ্গে সব কাজ তিনি সমাধান করতে পেরেছেন৷ জোগাড় করতে পেরেছেন সব বিভাগের অনুমতি ও সহযোগিতা৷ অদিতিবাবু বলেন, “গ্রিন করিডর তৈরি করে অঙ্গ পরিবহণের প্রশংসা করেছেন ‘ন্যাশনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লাণ্ট অর্গানাইজেশন’ (নোটো)৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.