রিংকি দাস ভট্টাচার্য: নদীতে মাছ নেই। খাল-বিলও প্রায় ফাঁকা। এমনকী বাংলার সাগরতটেও মাছের দেখা মিলছে না। অথচ একসময় এই বাংলার নদীনালা উপচে পড়ত রকমারি মাছের সম্ভারে। সেই সব ভ্যাদা, শোল, খলসে, পুঁটির জায়গায় বাঙালির উদরপূর্তিতে ভরসা এখন স্বাদহীন ব্রয়লার মুরগি অথবা ভেনামি, ভিয়েতনামি কইয়ের মতো বিদেশি মাছ।
তাহলে বাংলার চিরপ্রসিদ্ধ মৎস্য ভাণ্ডারের হীরে-মাণিক্য সব গেল কোথায়?
এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণই মৎস্য নিধনের জন্য দায়ী। তাঁদের কথায়, সাগরে পোড়া তেল ও বর্জ্যের দূষণ প্রক্রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তাতেই পালিয়েছে মাছের ঝাঁক। আবার মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের দ্রুত বিরূপ প্রভাব পড়ছে সামুদ্রিক পরিবেশের উপর। এতে সাগরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠার পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। বেপরোয়া হারে মাছ শিকার (ওভার ফিশিং) ও ব্যাট ফিশিং বা বিশেষ ধরনের নেট ব্যবহারের জেরে মাছের পোনা নিধনকে এর মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন অনেকে। মাছের প্রধান খাদ্য উদ্ভিদ বা প্রাণীজ প্ল্যাঙ্কটনের খোঁজে স্থানান্তরের জেরেও সাগর এলাকা থেকে মাছ হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। গোটা বঙ্গোপসাগর তটেরই এক হাল। যার ফল ভুগছে বাংলা, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের মৎস্যজীবীরা।
বস্তুত, সামুদ্রিক অর্থনীতির বা ব্লু-ইকোনমি-র জার্নালে বঙ্গোপসাগরকে এই সেদিনও জলজ সম্পদের ‘সুসমৃদ্ধ খনি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হত। প্রাণিজ প্রোটিনের বিরাট অংশের জোগান আসে সামুদ্রিক মাছ থেকেই। হরেক প্রজাতির মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল বঙ্গোপসাগরের মূল তিনটি মৎস্যচারণ এলাকা। কিন্তু বর্তমানে বঙ্গোপসাগর ক্রমশ মৎস্যশূন্য উপসাগরে পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
জলবায়ু গবেষক অনুরাগ দণ্ডর কথায়, এই এলাকায় মাছ কমে যাওয়ার অনেক কারণ। প্রথম কারণ অবশ্যই দূষণ। শিল্প-কারখানাগুলোতে ইটিপি না থাকায় রাশি রাশি বিষাক্ত বর্জ্য প্রতিদিন সাগরে অনায়াসে গিয়ে মিশছে। শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর ক্ষতিকর তেল-বর্জ্য সাগরে পড়ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও রয়েছে সামুদ্রিক মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের উপর। সামুদ্রিক জলের নুনের হার বা মাত্রায় অস্বাভাবিক তারতম্য ঘটলে মাছ বাঁচতে পারে না। আবার সমুদ্রতলের তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্র ক্রমশ এগিয়ে আসছে। “সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বছরে জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বারো মিলিমিটার।”–বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুগত হাজরা। ওই বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক গৌতম সেনের কথায়, সমুদ্রের বড় ঢেউ ভাঙতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য অন্যতম ভূমিকা নেয়। কিন্তু সেই বনভূমি ক্রমশ ধ্বংস হতে বসায় আগুয়ান সমুদ্র গ্রাস করছে নদীগুলিকে। নদীগুলির নোনাভাব বেড়ে মৃত্যু ঘটছে মিঠে জলের মাছের।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীদের কথয়, সাগরে হরেক জাতের মাছের আকাল চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। তবে গত কয়েক বছর সামুদ্রিক মাছের সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সাগরে গিয়ে জেলেরা অনেক সময়ই হতাশ হয়ে ফিরছেন। যার জেরে বাজারে মাছও অপ্রতুল। সামুদ্রিক মাছ যাও-বা আসছে তার দাম আকাশছোঁয়া। বস্তুত, বাজারে এখন বেশিরভাগই পুকুর-খামারের মাছ। বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছের দাম বলতে গেলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। স্বাদ ভুলতে বসেছে অনেকেই। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক জয়কৃষ্ণ হালদার জানিয়েছেন, চন্দনা, লাউফোলি, মেদকাটা, ম্যাকারেল, চ্যালা প্রজাতির মাছের আকাল গত চার-পাঁচ বছর ধরেই। শুধু বাংলা নয়, অন্ধ্র উপকূলের জেলেরাও একই রকম সমস্যার সম্মুখীন।
[পাচারের চেষ্টা বানচাল, চার আদিবাসী কিশোরকে উদ্ধার করল পুলিশ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.