দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: আজ থেকে ৩৭ বছর আগে ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন চোখে নিয়ে বন্ধু রামচন্দ্র বিশ্বাসকে সঙ্গী করে উত্তরপাড়া থেকে রওনা দিয়েছিলেন বছর ২৫-এর যুবক সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। বন্ধু বিশ্বভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরে এলেও বিভিন্ন অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে দেশে ফিরতে পারেননি সোমনাথ। শেষ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ফেসবুকের মাধ্যমে পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারপরই মাটির টানে সম্প্রতি সুদূর সেনেগাল থেকে নিজের জন্মভূমি উত্তরপাড়ায় পা রাখলেন সোমনাথ। সোমনাথবাবুকে ফিরে পেয়ে এখন রীতিমতো খুশি উত্তরপাড়ার ব্যানার্জিপাড়ার বাসিন্দারা। তাঁরা রীতিমতো ঘটা করে তাঁদের পুরনো দিনের সঙ্গীকে সংবর্ধনাও দেন। সোমনাথবাবুর বোন তাঁর দাদাকে পেয়ে আত্মহারা। আর তিনি তাঁর দাদাকে কখনওই কাছছাড়া করবেন না বলে জানিয়েও দিয়েছেন।
নিজের জন্মভূমিতে ফিরে এসে তাঁর এই ৩৭ বছরের রোমাঞ্চকর কাহিনির কথা শোনালেন সোমনাথবাবু। জানান রামচন্দ্র বিশ্বাস আর তিনি উত্তরপাড়া থেকে যাত্রা করেন। দিল্লিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্ল্যাগ অফও করেন। তারপর বিভিন্ন আফ্রিকান দেশ ঘুরে ১৯৮৬-তে গিনিভিসাতে পৌঁছন। কিন্তু সেখানেই বিপর্যয় নেমে আসে সোমনাথের জীবনে। তাঁর সাইকেল থেকে শুরু করে টেন্ট, সর্বস্ব চুরি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে পকেটে টান পড়ে। কিন্তু নিজের কারণে বন্ধুর স্বপ্নে কেন ছেদ পড়বে। তাই বন্ধু রামচন্দ্রকে তাঁর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বলেন। এই গিনিভিসা থেকে দুই বন্ধু আলাদা হয়ে যান। সে সময় খাবার কেনার পর্যন্ত পয়সা ছিল না। গিনিভিসাতেই ইউনেসকোতে কর্মরত এক ব্যক্তি তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। সোমনাথবাবু তাঁর স্কুল-জীবন থেকেই সাবান ও টুকিটাকি জিনিস তৈরি থেকে শুরু করে রেডিও সারাই ও গানবাজনায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী ছিল তাঁর শখের বাদ্যযন্ত্র ম্যান্ডোলিন। তিনি সাবান তৈরির কথা বলার পর ইউনেসকোর ওই ব্যক্তি তাঁকে সাবান তৈরির সরঞ্জাম এনে দেন। তা দিয়ে তিনি প্রচুর সংখ্যক সাবান তৈরি করার পর বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ দিয়ে একটা সাইকেল কিনে তারপর ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় সেনেগালের ভিসা জোগাড় করে সেই দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
কিন্তু সেনেগালে পৌঁছে ফের অর্থসংকটের সম্মুখীন হন সোমনাথ। ইতিমধ্যে বাড়ির সঙ্গেও সমস্তরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফিরে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সোমনাথবাবুর একটা সুবিধা ছিল, ছোট থেকেই মাঝেমধ্যে চন্দননগর যাওয়ার সুবাদে ফ্রেঞ্চ ভাষা রপ্ত করেছিলেন। সেনেগালেরও নাগরিকরা ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। সেনেগালের শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন ঘটান। ইতিমধ্যে ওই দেশের রেসিডেন্সশিপ পেয়ে যান তিনি। কাজ করে সেনেগালেই একটা ক্যাসেট-সিডি-ডিভিডির দোকান খোলেন। সেখানে ডিভিডিতে ভারতীয় সিনেমা দেখিয়ে ওই দেশের ছেলেমেয়েদের তা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবেই হিন্দি সিনেমা জগতের বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন আজ সোমনাথের দৌলতে তাঁদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত নাম। ডনের সেই বিখ্যাত গান ‘ম্যায় হুঁ ডন’ সেখানকার ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ঘোরে। এছাড়া সোমনাথের শিক্ষায় বাংলা ও হিন্দি গানের সঙ্গে নাচে পারদর্শী হয়ে ওঠেন সেনেগালের ছেলেমেয়েরা। মাঝেমধ্যেই বাবা, মা, বোনের জন্য মন খারাপ হলেও যোগাযোগ করতে না পারায় সেই ফিরে যাওয়ার আশাকে বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
ইতিমধ্যে সোমনাথবাবুর বাবা-মা দু’জনেই ছেলের শোকে মারাও গিয়েছেন। তা জানতেও পারেননি। এভাবেই সেনেগালে কেটে যায় ৩২টা বসন্ত। মানুষের হৃদয়েও স্থান করে নেন সোমনাথ। বছর ছ’য়েক আগে ফোনে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এই ফেসবুক অ্যাকাউন্টে খোঁজা শুরু উত্তরপাড়ার বন্ধুদের। এরই মাঝে উত্তরপাড়ারই এক বন্ধু সুব্রত দাস ফেসবুকে খুঁজে পান তাঁদের সোমনাথকে। তারপর থেকেই মাটির টানে দেশে ফিরে আসার আকুতি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু অর্থ পাবেন কোথায়। শেষ পর্যন্ত হরিয়ানার ছেলে অনু টুটেজা সেনেগালে ব্যবসা করতে গিয়ে ভাষা সমস্যায় পড়লে তাঁর সেই সমস্যার সমাধান করেন সোমনাথ। তারপর থেকেই অনুর কাছে সোমনাথ তাঁর পরিবারেরই একজন হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত অনু টুটেজা ও সেনেগালবাসীর ভালবাসা ও সহযোগিতায় দেশে ফেরার স্বপ্ন সার্থক হয়। দিন পনেরো আগে উত্তরপাড়ায় ফিরে আসেন তিনি। ফিরে আসার সময় সেই দেশের মানুষ চোখের জলে বিদায় জানিয়েছেন সোমনাথকে। তারা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, “আমাদের কাছে আবার ফিরে এসো, সোমনাথ। আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকব।” সোমনাথবাবু অবশ্য এখনও ঠিক করেননি, তিনি ফিরে যাবেন কি না। কিন্তু দীর্ঘ ৩৭ বছর বাদে দাদাকে পেয়ে বোন রুবি দাস (মুখোপাধ্যায়) জড়িয়ে ধরে বলেন, “আর কখনও দাদাকে কাছছাড়া হতে দেব না।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.