দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়াটা অত্যন্ত কষ্টকর৷ রোজ রোজ সেই কষ্ট করতে নারাজ ছোট ছেলেটি৷ ক্যানিং ১ নং ব্লকের ছেলেটি তাই স্কুলছুট হয়ে গিয়েছিল প্রায়৷ কিন্তু খুদের সেই সমস্যা সমাধান করে দিলেন বিডিও নীলাদ্রিশেখর দে৷ কীভাবে? সেই গল্পই শুনুন৷
অভাবের সংসারে স্কুলছুট ছেলেটিকে জরির কাপড় তৈরির কাজে পাশের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অন্যান্য সদস্যরা৷ কিন্তু মা বাদ সেধেছিলেন৷ তিনি চাইছিলেন, অন্যান্য তিন ছেলেমেয়ের মতো বাড়ির কাজ না করে, ছোট ছেলে রশিদ একটু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক৷ কিন্তু ছেলের এমন স্কুলবিমুখতা দেখে মা সোজা গিয়ে উপস্থিত হন বিডিও নীলাদ্রিশেখর দে’র কাছে৷ সমস্যার কথা জানিয়ে সমাধানের আরজি করেন৷ আর যেমন কথা, তেমনই কাজ৷ বিডিও নিজেই উদ্যোগী হয়ে একটি সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিলেন৷ শুধু সাইকেল নয়, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রশিদ সর্দারের হাতে তুলে দিলেন আরও বেশ কিছু সাহায্য৷ আর তাতেই বদলে গেল রশিদের জীবন৷ এখন নলিয়াখালি হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রশিদ রোজ সাইকেল চালিয়ে স্কুল যায়৷ আর বিডিও নীলাদ্রিশেখর দে’র এই উদ্যোগ যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে এলাকায়। স্কুলছুট ছেলেকে সাইকেল দিয়েই স্কুল ফেরানোর এই ব্যবস্থাকে। ইতিমধ্যে এর আগে কয়েকজনকে এভাবে স্কুলে পাঠিয়েছেন তিনি।
পরিবার সূত্রে খবর, রশিদ সর্দার ওই এলাকার নলিয়াখালি হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা আগ্রহ থাকলেও বেশ কিছুদিন হল সে আর স্কুলে যেতে চাইছিল না। রশিদ মাকে জানিয়ে দেয়, তার পক্ষে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়। গরীব মায়ের পক্ষে ছেলের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। অগত্যা পড়া ছেড়ে দিয়েছে ছেলে। এরপর পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা বর্ণনা করে মা রোশনারা দ্বারস্থ হন ক্যানিং-১ নম্বর ব্লকের ব্লক আধিকারিক নীলাদ্রিশেখর দে’র৷ লিখিত আকারে তিনি বিষয়টি বিডিও সাহেবকে জানান। বিডিও সবকিছু দেখেশুনে ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পের পড়ে থাকা বিভিন্ন সাইকেলের যন্ত্রাংশ দিয়ে জুড়ে একটি নতুন সাইকেল তৈরি করে দেন। সেই সাইকেল পেয়ে নতুন করে আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছে রশিদ। এ বিষয়ে রশিদ বলছে, ‘বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটাই। প্রায় এক ঘন্টার উপরে সময় লাগত পায়ে হেঁটে যেতে। যেতে আসতে দু’ঘন্টা সময় রাস্তাতেই চলে যেত। ফলে পড়াশোনা করতেই তা আর মন বসত না। তাই ঠিক করেছিলাম পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাড়িতে কাজ করব। ইতিমধ্যেই পাড়ার একটি জায়গায় জরির কাজ শুরু করেছিলাম।’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং ১ নম্বর ব্লকের নিকারীঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের পাংগাস খালি গ্রামে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে রোশনারা সর্দারের অভাবের সংসার। স্বামী হোসেন সর্দার বিশেষভাবে সক্ষম। তাই এই অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েকে পড়ানোই যথেষ্ট কষ্টের, তা বুঝেছেন রোশনারা বিবি। অগত্যা তাই তিনি চলে এসেছিলেন বিডিওর কাছে। রোশনারার কথায়, ‘‘স্বামী প্রতিবন্ধী। কোনও কাজ করতে পারে না। দিন আনি দিন খাই সংসার। কিন্তু রশিদ পড়াশোনা করবে বলেছিল, তাই ওকে স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতটা রাস্তা হেঁটে সে আর স্কুলে যেতে চায় না।’’
রাজ্য সরকার ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পের মাধ্যমে ইতিমধ্যে কয়েক লক্ষ সাইকেল বিলি করেছেন এ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। সরকারি নির্দেশমতো নবম ও দশম শ্রেণিতে সাইকেল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। সপ্তম শ্রেণিতে সাইকেল দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। আর সপ্তম শ্রেণিতে উঠে পড়া ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল এই স্কুলছুট ছাত্র রশিদ সর্দার। বিডিও-র সহযোগিতায় ওই ছাত্র আবার ফিরল স্কুলে। আর যার হাত ধরে এভাবে ফের স্কুল যেতে উৎসাহী হয়ে উঠল রশিদ, ক্যানিং১ নম্বর ব্লকের সেই বিডিও নীলাদ্রিশেখর দে বলছেন, ‘‘যে সমস্ত সাইকেলের যন্ত্রাংশগুলো পড়েছিল, সেগুলো দিয়ে এই সাইকেল তৈরি করে দিয়েছি। কারণ ‘সবুজ সাথী’ সাইকেলের যন্ত্রাংশগুলো যখন আসে তখন বহু যন্ত্রাংশ থেকে যায়, আর তাই সেই সব যন্ত্রাংশ জুড়েই এই সাইকেল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। শুধু সাইকেল দিয়েছে এমন নয় চাল, জামাকাপড় থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুই তাকে দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। কারণ, একটি প্রতিভা অঙ্কুরে বিনষ্ট হোক, আমরা তা চাইনি।’’ বিডিও-র এই অভিনব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন গ্রামবাসীরাও৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.