নবেন্দু ঘোষ, বসিরহাট: বছর বছর তিনি মর্ত্যে আসেন শুধুই কি বাপের বাড়ি ঘুরতে? তা তো নয়। তিনি আসেন অশুভ বিনাশ করতে, দুর্গতি নাশ করতে। তাই তিনি দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী। এ তো গেল কল্পিত দেবীর কথা। তবে আলাদা দৈবশক্তিতে নয়, বরং অন্তরের শক্তিতেই বাস্তবের অসুরদের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করা দুর্গতিনাশিনীরা রয়েছেন আমাদের চারপাশে। তাঁরাই আমাদের ঘরের মেয়ে উমা, আবার শক্তিদায়িনী দুর্গা। এমনই এক দুর্গাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
বোধিলাভের পথে কঠোর তপস্যারত অশক্ত শ্রমণ গৌতমকে পায়েসান্ন খাইয়ে দেওয়া সুজাতাকে মনে পড়ে? তিনিও তো মাতৃস্বরূপা। অন্য অর্থে, তিনিই ত্যাগের পথে হাঁটা গৌতম বুদ্ধকে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে জরা, মৃত্যু, ব্যাধি জয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর আমাদের এই প্রতিবেদনের নায়িকা সুজাতা নিজেই নেমেছেন রোগ বিনাশের কঠিন লড়াইয়ে। সুজাতা জানা। বসিরহাটের কন্যা। ছোট থেকে বেশ কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছেন। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মারণ ব্যধি ক্যানসারে অকালে হারিয়েছেন গুরুকে। সেটাই ছিল ধাক্কা। তারপর ক্যানসারের মতো ব্যধির কারণ অনুসন্ধান এবং রোগ বিনাশের উপায় খোঁজাকেই পাথেয় করেছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেলের এক ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা করেন সুজাতা।
তবে তাঁর সাফল্য নিয়ে এটুকু বললে, কার্যত কিছুই বলা হয় না। সুজাতার উড়ান আরও দীর্ঘ। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের পর পাঞ্জার এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তরের পর গবেষণার জন্য চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৯ সাল থেকে সেখানেই মূত্রথলির ক্যানসার সংক্রান্ত গবেষণায় ডুবে আছেন সুজাতা। বিদেশে স্কলারশিপ নিয়েই চলছে তাঁর গবেষণা। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে এই গবেষণায় অনুদান দেওয়ার জন্য এক কঠিন পরীক্ষার আয়োজন করা হয় সম্প্রতি। সাহস করে সেই পরীক্ষায় বসে পড়েছিলেন সুজাতা। আর কল্পনাতীতভাবে দারুণ সাফল্য! ক্যানসার নিয়ে নিজস্ব ভাবনা ও পরিকল্পনার পরিচয় দিতে এত বর্ষীয়ান গবেষকদের মধ্যে থেকে বছর পঁয়ত্রিশের সুজাতাই একমাত্র অনুদান প্রাপক হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। এমনকী নিজের গাইডকেও এই পরীক্ষায় হারিয়ে দিয়েছেন বসিরহাটের কন্যা। অনুদানের অঙ্ক ২লক্ষ ৬৮ হাজার ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যা ১ কোটি ৮৭ হাজারেরও বেশি টাকা।
এ যেন স্বপ্নের মতো। এই অনুদান জয়ের ঘোর যেন কাটছে না সুজাতার। সিয়াটেল থেকে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে ফোনে বললেন, ‘অনুদান পাওয়া তো দূর, এই পরীক্ষায় বসতেই আমি ভরসা পাচ্ছিলাম না। ছোটবেলায় স্যার প্রণব গায়েনকে দেখেছি কোলন ক্যানসারে মারা যেতে। সেই থেকেই ঠিক করেছিলাম, এই রোগের কারণ নির্ণয় করতেই হবে। সেই পথেই আমি এগোচ্ছি। এই মোটা অঙ্কের অনুদান আমি খুব ভালভাবে কাজে লাগাতে চাই।’ ঘরের মেয়ে আপন গুণে বিদেশের মাটিতে সমাদৃত। বাবা, মায়ের আনন্দ যেন বাঁধ মানছে না। মা গীতাদেবী অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলছেন, ‘ছোটবেলায় অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে পড়াশোনা করেছে। স্কুলে ভ্যান চড়েও যেতে পারত না। হেঁটেই যেত। আর সেই মেয়ে এখন আমাদের বিমানে চড়িয়ে নিউইয়র্ক ঘোরাচ্ছে! ছোটবেলায় স্কুলে সুজি ছাড়া কিছু টিফিন দিতে পারতাম না। তাই স্কুলের বন্ধুরা ওকে সুজি বলে ডাকত।’
সেদিনের ‘সুজি’ আজ মার্কিন মুলুকে গিয়ে হয়ে গিয়েছেন ‘পিসমেকার’, শান্তিময়ী। শান্তশিষ্ট আচরণের ভিতরে ভিতরে চাপা আগুন, যে আগুন পুড়িয়ে দিতে চায় কর্কটের জীবাণু। সুজাতা নাম্নী দুর্গতিনাশিনী এখানে কর্কটবিনাশিনী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.