টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: সিমেন্ট, বালি, ইটের গাথনিতেও সম্প্রীতি। ধর্ম যেখানে রাজনীতির মেরুকরণ করে দেয় সেখানেই মেশে ভালবাসা। ধর্মীয় জীর্ণতাকে সরিয়ে উঁকি দেয় সম্প্রীতির ভালবাসা। পাথুরে মাটিতেও সহাবস্থানের বার্তা। কর্মক্ষেত্রে একযোগে বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন করে সম্প্রীতির বার্তা দিলেন নির্মাণ শ্রমিকরা। ঘটনাস্থল বাঁকুড়া শহরের উপকণ্ঠে কুচকুচিয়ার ফাঁসিডাঙা। তিনমাস ধরে গুদাম তৈরির কাজ করছেন মিজানুর অসীমরা। দেখতে দেখতে বিশ্বকর্মা পুজো চলে এল। বাড়ি যেতে পারবেন না, তাতে কী। কর্মস্থলেই পুজোর আয়োজন করে ফেললেন তাঁরা। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ঠিকাদার নিজেই মূর্তি কিনে পুরোহিত খুঁজে আনলেন। ধুমধাম করে পালিত হল বিশ্বকর্মা পুজো। সহকর্মীদের খুশি রাখতে ঠিকাদারের এহেন উদ্যোগে মুগ্ধ ফাঁসিডাঙার স্থানীয় বাসিন্দারা।
নির্মাণ শ্রমিকদের ঠিকাদারির কাজ করেন সেলিমু্দ্দিন শেখ। বীরভূমের বাসিন্দা সেলিমুদ্দিন কর্মসূত্রেই বাঁকুড়াতে বসবাস করেন। টানা সাত বছর ধরে এখানেই রয়েছেন তিনি। রুটিরুজির টানে বীরভূম থেকে অনেকেই তাঁর ঠিকাদারি সংস্থার অধীনে কাজ করতে এসেছেন। কেউ টিকে গিয়েছেন। কেউ বা অন্য কোথাও কাজের সূত্রে চলে গিয়েছেন। সেলিমুদ্দিনের সংস্থায় কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকদের কেউ হিন্দু কেউবা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পুজো আসে পুজো যায়, তাঁরা কাজ করে যান। শুধু বিশ্বকর্মা পুজো এলেই মন খারাপ হয়ে যায়। সেদিনও কর্নিক, কড়াইকে হাতিয়ার করে ওলনের দড়ি এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। মন খারাপের মাঝেই ঢালাইয়ের পেরেক তুলতে গাঁইতিতে চাপ পড়ে। নিজের সংস্থার কর্মীদের এই দুঃখী মনোভাব সেলিমুদ্দিনের সহ্য হচ্ছিল না। তাই বছর পাঁচেকে আগে নিজেই বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন করেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রবিবার বিকেলে সেলিমুদ্দিন স্থানীয় বাজারে গিয়ে বিশ্বকর্মার মূর্তি কিনে আনেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে পুরোহিতের খোঁজখবর নেন। রবিবার সন্ধ্যায় পুরোহিত ঠিক করে আসেন। যেন সকাল সকাল তাঁদের পুজো সম্পন্ন হয়। কেননা শ্রমিকরা নিজেরাই পুজোর কর্তা। নিজেরাই যাবতীয় কাজ করবেন। তাই তাড়াতাড়ি পুজো হয়ে গেলে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের জন্য ছুটোছুটির দরকার পড়ে না। সকালেই স্নান সেরে কাজে লেগে পড়েন মিজানুর, অসীমরা। ফল কেটে গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি পুরোহিতের প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে দেন। ধুমধাম করে সম্পন্ন হয় পুজোর কাজ।
প্রসাদ খেয়ে ততক্ষণে রান্নায় লেগে পড়েছেন সেলিমুদ্দিন। ঘেমেনেয়ে একসা অসীম মাল জানালেন, প্রতি বছর মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায় পুজো হয়। তাই অন্য কোথাও কাজে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। মালিক রবিবার মূর্তি কিনতে গেলে নিজেরাই প্লাস্টিক দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়ে তোলেন। তারপর বাক্স এনে শুরু হয় গানবাজনা। এর মধ্যে পাত পেড়ে খাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। ১২জন শ্রমিক নিজেরাই পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। বিশ্বজিৎ সাহা তৃপ্তির ঢেকুড় তুলে জানালেন, নির্বিঘ্নেই মিটেছে পুজো। তাঁরা খুশি। সব থেকে খুশি ঠিকাদার সেলিমুদ্দিন নিজে। বললেন, পুজো মানেই আনন্দ। সহকর্মীরা আনন্দে থাকলে আমিই সবথেকে বেশি খুশি থাকব। সেকারণেই পুজোর আয়োজন।
উল্লেখ্য, তিনমাস ধরে বাঁকুড়ার প্রখ্যাত কাপড় ব্যবসায়ীর জমিতে গুদাম তৈরির কাজ করছেন অসীম, মিজানুররা। তিনমাস ধরে একই পাড়াতে থাকছেন। বাসিন্দাদের সঙ্গেও একটা পরিচিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেলিমুদ্দিন শেখের মূর্তি নিয়ে আসার ঘটনায় ধন্য ধন্য করছেন স্থানীয় বাসিন্দা কাঞ্চন নাগ। এমন সম্প্রীতির নজির তিনি আগে দেখেননি। তবে চান, এমন সম্প্রীতির নজির স্থাপিত হোক বাংলার প্রতিটি প্রান্তে। তাহলে মেরুকরণের রাজনীতিকে ছুরির ভূমিকায় দেখা যাবে না। ধর্মের নামে রক্তপাতের ইতি ঘটবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.