তরুণকান্তি দাস: ফরওয়ার্ড ব্লকের একনিষ্ঠ কর্মী। উত্থান বাম আমলে। বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতে থাকা খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রীর হাত ধরেই। অসুস্থ তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীকে কিডনি দিতে নিজের পয়সায় পৌঁছে যাওয়া দিল্লিতে। এবং তাঁর বদান্যতায় রকেটের গতিতে উপরে ওঠা, খাদ্য দপ্তরের দুর্নীতির চোরাগলিতে ঢুকে রাজার হালে জাঁকিয়ে বসা। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপা-বাদুড়িয়া রোডে মামার রাইসমিলের সামান্য কর্মী থেকে কয়েকশো কোটি টাকার মালিক বাকিবুর রহমানের জীবনের ইতিহাসের পরতে পরতে চমক। তিনি আদৌ কিডনি দিয়েছিলেন কিনা বাম খাদ্যমন্ত্রীকে তাও ধোঁয়াশায় ভরা, কারণ খাতায় কলমে ওই মন্ত্রীকে কিডনি দাতার নাম শাহ আলম, যিনি খিদিরপুরের যুবক, প্রয়াত মন্ত্রীর প্রতিবেশী।
তবে যা নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা নেই, তা হল পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী একাধিক রাজ্য থেকে শুরু করে উত্তর পূর্বাঞ্চলে রেশনের পণ্য খোলা বাজারে সরিয়ে ফেলার চক্রের বিস্তার বাম আমলেই। কলকাতার বন্দর এলাকা থেকে জিতে খাদ্যমন্ত্রী হওয়া ফরওয়ার্ড ব্লক নেতার মৃত্যুর পরে উত্তরবঙ্গের এক মন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য বাকিবুরকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। যা পরে আরও ছড়িয়ে পড়ে খাদ্য দপ্তরেররই এক অফিসারের মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা বাকিবুরের হাত ধরে দক্ষিণবঙ্গের মূলত তিনটি জেলায়। দুই ২৪ পরগনা ও নদিয়া। কিন্তু কী ভাবে? দুটি সহজ উপায়। প্রথমত, যে সব গ্রাহক রেশনে পণ্য তোলেন না তাঁদের পণ্য খাতায় কলমে বিক্রি দেখিয়ে পরে খোলা বাজারে চড়া দামে পাচার। যে কাজে রেশন ডিলারদের একাংশ যুক্ত বলে ইডি’র দাবি। এবং রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিলের ভাল গুণমানের চাল, আটা বাজারে বিক্রি করা, তার জায়গায় নিম্নমানের পণ্য সরকারকে গছানো। এখন ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ২ হাজার ১৮৩ টাকা। কিষান মান্ডিতে গিয়ে বেচলে বাড়তি পরিবহন খরচ ২০ টাকা মেলে। চাষিদের থেকে ধান কাটার সময় মাঠেই তা কম দামে কিনে সরকারের কাছে নানা কৃষকের নামে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা নিয়েছেন বাকিবুর।
এই সবই নাকি বিক্রি হয়েছে কিষান মান্ডিতে। যার দরুন বাড়তি পরিবহণ ভাতা হিসাবেই কয়েক বছরে কোটি টাকার বেশি পকেটে পুরেছেন বাকিবুর। এইসব কারবার চালাতে অনেক ছোট ছোট ফার্ম বানাতে হয় খাতায় কলমে। যা করেছিলেন তিনি। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় ঘোঁটালা হল রাইসমিল নিয়ে। প্রতিটি মিলের ক্ষমতা অনুযায়ী রাজ্য তাকে ধান দেয় চাষিদের থেকে সহায়ক মূল্যে কিনে নিয়ে, যার বিনিময়ে চাল পায়। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বেঙ্গল রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি বাকিবুরের দখলে থাকা হাতে গোনা খান আটেক মিলের কপালে বারবার বরাদ্দ হয়েছে বিপুল ধান। বর্ধমানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মিল আছে রাজ্যে। অথচ সেখানকার প্রায় ১২০টি মিল যা ধান পেয়েছিল ওই সময়, তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি পেয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ার মিলগুলো যার নিয়ন্ত্রণ বাকিবুরের। কিছু নিজের, কিছু বেনামে। সেগুলোর যা চাল তৈরির যা ক্ষমতা তার চেয়ে বেশি ধান সরকারের থেকে নিয়ে তা খোলা বাজারে বেচে কম দামি নিম্নমানের চাল কিনে সরকারকে দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন বাকিবুর।
এখন এক কুইন্ট্যাল ধান দিয়ে সরকার মিল থেকে পায় ৬৮ কেজি চাল। তার জন্য মিল মালিক পান শ্রমিক খরচ ১০ টাকা ৩৩ পয়সা, কারখানার খরচ ৩০ টাকা এবং পরিবহণ খরচ। ফলে বাইরে ধান বিক্রি করা মানে সেই সরকারি টাকা পাওয়া এবং খারাপ চাল কিনে তা সরকারকে গছিয়ে মার্জিন মানি পকেটস্থ করা। যা থেকেই মূলত ফুলে ফেঁপে উঠেছেন বাকিবুর। সেইসব নথিই পেয়েছে ইডি। বেশ কিছু রাইস মিলের বিদ্যুৎ বিল এ ক্ষেত্রে বড় হাতিয়ার, যা প্রমাণ করছে ওই মিলের চাল উৎপাদন ক্ষমতা। অর্থাৎ, বছরে যে মিলের ধান ভাঙানোর ক্ষমতা ধরা যাক ১২ শো টন, তার কপালে ভার পড়েছে ১২ হাজার টান ধান থেকে চাল তৈরির। টাকার পাহাড়ে দ্রুত চড়ার এটাই পথ বাকিবুরের।
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা চিরকালই ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের ঘাঁটি। জেলা সদর বারাসাত তো বটেই, তার পাশের ওই বিধানসভা কেন্দ্রটি চিরকালই সিংহের দখলে ছিল। বারাসাত থেকে জিততেন সরল দেব। বাকিবুরের মামার রাইস মিল দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা থেকে বাদুড়িয়াগামী রাস্তায় দু-এক কিলোমিটারের মধ্যেই । সেখানেই হাতে খড়ি বাকিবুরের। বিয়ে করে সেখানেই তাঁর থাকা। এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে রাজনীতির মাঠে নামা। ক্রমশ মধ্যমগ্রামের এক বিধায়ক-মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। সেই সিঁড়ি ধরে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ। যখন তিনি কিডনিজনিত সমস্যায় দিল্লিতে চিকিৎসাধীন, তখন দলের তরফেই বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিডনি জোগাড়ের। বাকিবুর খবর পেয়ে দিল্লি পোঁছন। তারপরই কপাল খোলে তাঁর। রেশন ডিলার হন তিনি। এবং ক্রমে বেড়াচাঁপাতেই এনপিজি রাইস মিল। সেই মিল এত বড় যে তেমনটি রাজ্যে আর কটি আছে তা বলতে পারছেন না রেশন ডিলার সংগঠনের লোকজনই। বাকিবুরের মামাতো ভাই পঞ্চায়েত সমিতির নেতা। বাকিবুরের মামার হাত ধরে উঠলেও মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। একসময় মধ্যমগ্রামের একটি ফ্ল্যাটে এসে এঠেন বাকিবুর। তারপর ভিআইপি রোডের অদূরে চিনার পার্কের বিলাসবহুল আবাসনে। যেখান থেকে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার দুবাই পর্যন্ত।
কিন্তু রিভলভিং চেয়ারে দুই পা তুলে টয়লেটে বসার স্টাইলে অভ্যস্ত বাকিবুরের দিকে নজর পড়ল কী করে? করোনা আবহে পাঞ্জাব থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তে প্রায় ১০০ লরি গম আটক করে কাস্টমস। সেই গম নিলামে নগদে কিনে নিয়ে শুল্ক ও আয়কর দফতরের নজরে পড়ে যান বাকিবুর। সেই নজরদারির পর একবার আয়কর হানাও হয়েছিল তাঁর ফ্ল্যাটে। আর এবার একেবারে ইডির জালে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.