গোবিন্দ রায়: সময়টা ছিল বাম আমল। উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ ব্লকের বিশেষ এক পঞ্চায়েত। নাম শুনলেই শিড়দাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত খেলে যেত মানুষের। শুধু সেই পঞ্চায়েতই নয়, গোটা ব্লকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ এক সিপিআইএম নেতার নামও। যাঁর নামে সেই সময় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত বলে প্রচারিত। তিনি বাবু মাস্টার। হাসনাবাদের পাশাপাশি, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকেও দলীয় কর্মীদের ভোট করতে একটাই নামই যথেষ্ট ছিল। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দু’দশক পেরিয়েছে। লোকসভার মহারণ এবার। কিন্তু এসবের থেকে বিশ মাইল দূরে তিনি! আগের মতো দিন-রাত এক করে গাঁ-গঞ্জ চষে ফেলা নেই। নেই গা গরম ভাষণও। তাঁর ‘কুখ্যাত’ বাহিনীও রাতারাতি গায়েব। বাড়ি লাগোয়া চায়ের ঠেকে সকাল-বিকেল আড্ডা জমলেও সেখানে রাজনীতির লেশমাত্র নেই। তাহলে কি শাসনের এক সময়ের ‘ত্রাস’ মজিদ মাস্টারের মতো বাবু মাস্টারও রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিলেন?
তবে এ কথা মানতে নারাজ স্থানীয়রা। তাঁরা বলছেন, “মাস্টার মাঠে নেই। কিন্তু খেলায় আছেন। এখনও তিনি ভোটের ময়দানে নামলে হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়বে।” পার-হাসনাবাদের কুদ্দুস গাজীর কথায়, “এই তো মাস দুয়েক আগে এখানে এসেছিলেন তিনি। তৃণমূলে তাঁর পুরানো সহকর্মী, দীর্ঘদিন ধরে ঘরপোড়া বলাই দাসকে দেখতে। তাঁর আসার খবর পেয়ে আসে পাশের মানুষ যেভাবে জমায়েত হয়েছিল তাতে টাকি রোড অবরুদ্ধ হয়ে যায়। শেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে নামতে হয়। বাতিল করে দেওয়া হয় তাঁর সমস্ত কর্মসূচি।” গত পঞ্চায়েত ভোটে তাঁর বাড়ি যেখানে, সেই ভবানীপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল। মৃদু হেসে মাস্টার বলছেন, “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। সময় শেষ কথা বলবে। লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর দুধ-জল পরিষ্কার হয়ে যাবে।” তাঁর কথায়, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এই রকম একটা নির্বাচনে আমাকে টেনশন ফ্রি রাখার জন্য।” তবে নাগরিক হিসেবে স্বপরিবারে ভোট দেবেন অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি।
২০০১ সালে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে ভবানীপুর মডেল হাই স্কুলে যোগ দেন ফিরোজ কামাল গাজী। শুরুতে ছিলেন সিপিএমের সক্রিয় কর্মী। ২০০৩ সাল থেকে ভবানীপুরে সিপিএমের ভোট ম্যানেজারে পরিণত হন তিনি। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাবু মাস্টার। সেই সঙ্গে সদা হাস্যময় ও মৃদুভাষী এই শিক্ষকের বাহিনী নিয়ে তৎকালীন বিরোধীদের অভিযোগ বাড়তে থাকে। সেই বাহিনীর দাপটে ভবানীপুর দ্বীপ এলাকা কার্যত বিরোধীশূন্য হয়ে যায়। ২০১১ সালের রাজ্যে পালাবদলের পর তিনি যোগ দেন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসে। তাঁর উত্থান হয় রকেটের গতিতে। একে একে তৃণমূলের হাসনাবাদ ব্লক সভাপতি, বসিরহাট লোকসভার আহ্বায়ক, জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ হন। ওই সময় যে বসিরহাট তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রশ্নাতীত।
হঠাৎ সেই বাবু মাস্টার রাজনীতি থেকে এত দূরে? স্থানীয়দের দাবি, হাসনাবাদ-হিঙ্গলগঞ্জের তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে মান-অভিমানের জেরে দূরত্ব বাড়ে দলের সঙ্গেও। ২০২১ সালে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন তিনি। সেই থেকে ছন্দপতন। মিনাখাঁয় তাঁকে খুনের চেষ্টা, বিজেপির সঙ্গে মতৈক্যের জেরে বিজেপি ত্যাগ, পরে দুদফায় অস্ত্র সহ গ্রেপ্তারির পর জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এখন ছাপোষা গৃহস্থ।
একসময়ের লড়াকু নেতা এখন পুরো সময়টাই তিনি পরিবারের সঙ্গে কাটাচ্ছেন বলে জানান। বলেন, “স্কুল ছুটি তাই বাড়িতেই আছি। কিছু ছাত্রছাত্রী অসুবিধায় পড়ে মাঝেমধ্যে আসে তাদেরকে দেখিয়ে দিই।” তবে আগের মতোই গ্রামের চায়ের দোকানে বসেন সকাল-বিকেল। ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও পরামর্শ নিতে হাজির হন অনেকে। কিন্তু রাজনীতি, নৈব নৈব চ। সত্যিই কি তাই?
স্থানীয়দের অবশ্য বক্তব্য, ভবানীপুর-১ ও ২ গ্রাম পঞ্চায়েতে ‘দলহীন’ বাবু মাস্টারের প্রভাব আজও অটুট। তাঁর সময়ে রাস্তাঘাট থেকে বিদ্যুৎ, জল, ব্রিজ এই দ্বীপের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে বলে মনে করে মানুষ। মডেল বাজারকে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েতে ১২ হাজারের বেশি ভোটে লিড পেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেখানেই এগিয়ে যায় বিজেপি। এবার ভবানীপুর-২ পঞ্চায়েতে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী। গ্রামের বাসিন্দা শওকত মোল্লা, গিয়াসউদ্দিন গাজি বলেন, “ভবানীপুর সাজিয়েছে বাবু মাস্টার। তাই এখন উনি কোনও দল না করলেও কোথাও গেলে লোকজন ভিড় করে।” কিন্তু ওঁর কুখ্যাত বাহিনী? গ্রামবাসীদের বক্তব্য, ওঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা এসব করত। তারা এখন আর ওঁর সঙ্গে নেই। তবে এটা ঠিক, উনি না চাইলে এবার তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারত না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.