সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দেশের নাম কি? প্রশ্ন শুনে অবাক চোখে তাকান ওরা। ফের একবার একই প্রশ্ন করলে ভি়ড়ের মধ্যে থেকে এক প্রৌঢ় বলে ওঠেন, ‘বড়গোড়াই তো হামদের দেশ।’ আর ভোট? ‘নাই জানি’ বলে সরেই যান দু’তিন জন মহিলা। সেখান থেকেই অবশ্য একজন বলে ওঠেন, “ভোটটা কবে যে বটে? উটাই বুঝে পাছি নাই।”
দেশের নাম বা ভোটের দিনক্ষণ তাঁদের জানা না থাকলেও মোদি আর মমতার নাম শুনেছেন তাঁরা। কিন্তু, ১৭তম লোকসভা ভোট নিয়ে যখন গোটা দেশ সরগরম। সবাই যখন মজে আছেন রাজনৈতিক নেতাদের বাকযুদ্ধে তখন এর কোনও তাপ-উত্তাপই নেই এখানে। তাই নেই কোনও দেওয়াল লিখনও। এমনকী, কোনও রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী প্রচারের জন্য পা রাখেনি এই জনপদে।
ডিজিটাল ইন্ডিয়া নামক প্রদীপের তলায় আজও এইভাবে পড়ে আছে ভারতবর্ষের একটি গ্রাম বড়গোড়া। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি পাহাড় কোলে একপাশে থাকা এই গ্রামটি সমতল থেকে প্রায় শ’খানেক ফুট উঁচুতে। চারিদিকে জঙ্গল ঘেরা এলাকায় পাহাড়িয়া জনজাতিদের বাস। ১৪টি পাহাড়িয়া পরিবার। সেই গ্রামে পা রাখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে। গ্রামের একেবারে পিছন দিকে কাঁঠাল গাছের তলাতেই যে বনপার্টির লোকেরা মিটিং বসাত। লম্ফ নিয়ে বিপ্লবের পাঠ দিত। সমাজ বদলানোর স্বপ্ন দেখাত। গণ আদালতে শাস্তির কথাও আলোচনা হত এই কাঁঠাল গাছের তলায়। তারপর বন্দুক নিয়ে কার্যকর হত মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা। মিটিং বসত ভোট বয়কটের। ফলে এই বড়গোড়া সেভাবে বুথমুখী হত না।
কিন্তু, এখন দিন বদলেছে। বনপার্টি আর নেই। ফলে রাতের অন্ধকারে লম্ফ নিয়ে বসে না মিটিং। গণ আদালতে শাস্তির কথাও উঠে আসে না। আলোচনা হয় না ভোট বয়কটের। তবুও নির্বাচন কমিশনের ভাষায় দেশের সবচেয়ে বড় পরব ‘ভোট উৎসব‘ নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই এই বড়গোড়ার। তাই রতন পাহাড়িয়া ও লখিরাম পাহাড়িয়া বলেন, “ভোটের আগের দিন স্লিপ দিতে আসবেক। তখনই জানতে পারব কবে ভোট বটে।” এর বেশি লোকসভা ভোট নিয়ে আর কোনও ভাবনাই নেই এই পাহাড়ি জনপদের। থাকবেই বা কি করে? গাঁয়ের একটি মাত্র কুয়োতে এই বৈশাখেই জলস্তর নেমে গিয়েছে ৪০ ফুট নিচে। তাই প্রায় এক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ভেঙে অযোধ্যা পাহাড়ের বাঁকাদহ ঝরনা থেকে হাঁড়ি-কলসি নিয়ে জল আনতে হয় মহিলাদের।
দু’বেলা ভরপেট খাবার জোটাতে, দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কাঠ কুড়িয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বলরামপুর হাটে বিক্রি করতে যেতে হয়। তারপর সেই কাঠ বেঁচে পাওয়া টাকায় ১৬ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি পথে অযোধ্যা হিলটপের কচুরিরাখা গ্রাম থেকে রেশন আনলে তবেই উনুনে হাঁড়ি চড়ে। তাই অমর পাহাড়িয়া ও সাগর পাহাড়িয়া বলেন, “পেট চালাতেই যে দিন চলে যায়। তাই ভোট-টোট নিয়ে কোনও চিন্তা মনে আসে নাই।” ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা যাওয়ার পথে শিমূলবেড়া বুথে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের মানেও যেন সঠিকভাবে বোঝে না এই বড়গোড়া। তাই, দেশের নাম জানা নিয়েও কোনও উৎসাহ নেই ওঁদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.