কুণাল ঘোষ, আমতার কুরিট গ্রাম থেকে: হ্যাঁ, দুর্গাপুজো (Durga Puja), এখন এই মাঘেও। হ্যাঁ, আরেক অকালবোধন। হ্যাঁ, এই বাংলাতেই। রবিবার, সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন, শুক্লা, মানে বসন্ত ষষ্ঠীতে হাওড়া জেলার আমতার কুরিট গ্রামে আবার মা দুর্গার আরাধনা। পাঁচদিনের পুজো। ষষ্ঠীর বোধন, কলাবউ স্নান, সন্ধিপুজো থেকে দশমী, প্রতিটি রীতি ও আচার মেনে। কোভিডবিধি মেনে ছোট্ট মেলাও। আয়োজনে মেতে উঠেছে কুরিট এবং চারপাশের গ্রামগুলি।
সরস্বতী পুজোর দিন এই সবুজমোড়া গ্রামাঞ্চলে এসে যা দেখছি, তাতে ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহি নমস্তুতে’-শোনা যাচ্ছে এদিক-ওদিক থেকে। ছেলেমেয়েরা সাজুগুজু করে পুজোয় মেতে। পুরোহিতদের ব্যস্ত যাতায়াত। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে যেন আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মহিষাসুরমর্দিনী। মায়ের পদধ্বনি স্পষ্ট। পুরোদস্তুর দুর্গাপুজোই বটে। তবে এখন এখানে ‘কাত্যায়নী’ নামে, নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ। শক্তি, শস্য, সমৃদ্ধির প্রতীক। উজ্জ্বল গৌরবর্ণা মা। প্রশ্ন হল, এখানে অকালবোধন কেন? লঙ্কায় রাবণবধে যাওয়ার সময় রামচন্দ্র একবার মায়ের অকালবোধন করেছিলেন। সেটিই এখন পরিচিত আশ্বিনের দুর্গাপুজো। তাহলে এখানে এই আমতার কুরিটগ্রামে অকালবোধন কেন?
কারণটা এরকম: এই গোটা এলাকা কৃষিনির্ভর, শস্যশ্যামলা। কৃষিই এখানকার জীবন। ছয়ের দশকের শেষদিক এবং সাতের দশকের গোড়ার দিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসলের লাগাতার ক্ষতি হতে থাকে। গরমে খরা, খালবিল শুকনো এবং তারপর বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা। ক্ষতি হতে থাকে বিশাল সংখ্যক পরিবারের। অনেক পুজো, যজ্ঞ করেও সমস্যা কাটেনি। সেই সময় দুই পুরোহিত এবং এক তান্ত্রিক এই অকালবোধনের বিধান দেন। বলেন, কাত্যায়নী শাস্ত্রমতে পুজো করতে হবে। মা দুর্গার কাত্যায়নী রূপের আরাধনা। যেহেতু এখানে শস্যই জীবিকা, তাই এই পুজোর আয়োজন ও উপচারে শস্যের প্রাধান্য। সেই সময় থেকেই এখানে কুরিট, চাকপোতা, বলরামপুর, বড় ও ছোট মোহাম্মদ, কাটাকাটি বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ শুক্লাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন করে থাকেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিবার। এই ঐতিহ্যই চলে আসছে। এবারও হবে, রবিবার সন্ধেতে।
শনিবার যখন কুরিট গ্রামে পৌঁছেছি, তখন উত্তম কোলে, দুলাল কোলেরা তারাময়ী আশ্রম প্রাঙ্গণের মণ্ডপে আয়োজনে ব্যস্ত। উত্তমবাবু প্রথম দিন থেকেই অকালবোধনে আছেন। বললেন, “সেই তান্ত্রিকের কথায় অকালবোধনে কাত্যায়নীপুজো শুরুর পর যেন ম্যাজিক হল। বিশ্বাস করুন, এই এলাকায় এখনও আর খরা-বন্যা নেই। জল একবার এলেও একটি অঞ্চলে হাঁটুজল, তারপর নেমে গিয়েছে।” এই পুজোয় দুর্গাপুজোর সব রীতিই অনুসরণ করা হয়। তবে প্রাধান্য দেওয়া হয় তন্ত্রমতকে। নবমীর দিন হয় যজ্ঞ। পেরো থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার পিয়ালি ঘোষ তত্ত্বাবধানে এসেছিলেন। পল্লিবাসীদের বললেন, “ঐতিহ্য থাকুক। সহযোগিতা করব। কিন্তু কোভিডবিধি মানতে হবে সকলকে।”
মণ্ডপ তৈরি। তবে প্রতিমা আসবে রবিবার বিকেলে। সন্ধেতে বোধন। আঠারোহাত সিংহবাহিনী। প্রতিমা তৈরি হচ্ছে একটু দূরে, কুমোরপাড়ায়। শিল্পী অষ্ট পাল। গেলাম সেখানে। রং পড়বে একটু পরেই। কুমোরপাড়ায় আপাতত এই একটিই কাজ চলছে। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ-সহ মা দুর্গা। এবং ঋষি কাত্যায়নের মূর্তি। কুরিট বা কুমোরপাড়া, মুখে মুখে নানা কাহিনি। কোথাও শাস্ত্র, পুরাণ, বেদ থেকে দেবী কাত্যায়নীর ইতিহাস। কখনও এই এলাকার অকালবোধন এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহ। কাত্যায়ন মুনিকে কেন্দ্র করে মা কাত্যায়নীর রূপের নানা কাহিনি। ঘুরেফিরে অধিকাংশটাই মা দুর্গাসংক্রান্ত কাহিনির সঙ্গে যুক্ত। পুরাণে কোথাও তিনি ঋষি কাত্যায়নের কন্যা, কোথাও পত্নী। কোথাও ঋষি কাত্যায়নের প্রার্থনায় অসুরকুল বধ করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর-সহ দেবতাদের মিলিত শক্তির সৃষ্টি এবং তাঁদের সৌজন্যেই অস্ত্রলাভ। কোনও পুরাণে তিনি ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যর স্ত্রী। এরকম নানা কাহিনি। পতঞ্জলি ভাষ্য থেকে শুরু করে স্কন্দপুরাণ এবং যজুর্বেদে এঁর স্পষ্ট অবস্থান। ওড়িশার কাহিনিতে ইনি প্রভু জগন্নাথের সঙ্গে উচ্চারিত। জৈন, বৌদ্ধ পুঁথিতেও আছেন মা। নবদুর্গা, মানে পার্বতীর ষষ্ঠ এই রূপকে সিংহ দিয়েছিলেন পার্বতীই। আবার মহারাষ্ট্র-সহ কোনও কোনও জায়গায় রক্তবীজ অসুরদের দমনে মা কাত্যায়নীর ভূমিকার যা বর্ণনা, তাতে খানিকটা মা কালীর সঙ্গে মিল আছে।
এখানে, আমতায়, এই অকালবোধনে কিন্তু কাত্যায়নীর সিংহবাহিনী অষ্টাদশভুজা দুর্গারূপ। এই শাস্ত্র মেনে আরও কিছু জায়গায় পুজো হয়। কিন্তু শস্য বাঁচাতে অকালবোধনের পুজো কুরিটকে নতুন করে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। কাত্যায়নশাস্ত্রের দিনক্ষণ নয়, এঁরা অকালবোধনে এসে মায়ের আশীর্বাদের অনুভূতিতেই আচ্ছন্ন। রবিবার সন্ধের বোধন থেকে পুরোদস্তুর দুর্গাপুজোর আমেজে মাখামাখি থাকবে গোটা এলাকা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.