সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: সুপার সাইক্লোন আমফানের ভয়ঙ্কর শক্তির কাছে হার মেনেছে করোনার আতঙ্ক। করোনাভীতি আপাতত দূরে সরিয়ে এখন আমফানের ধাক্কা সামলাতেই ব্যস্ত সুন্দরবনের মানুষ। দু’দিন আগেও যে করোনার আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছিল বাদাবনের বাসিন্দাদের, আপাতত তা উধাও। তাঁদের যত দুশ্চিন্তা এখন আমফান পরবর্তী কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন, তা নিয়েই।
আমফানের তাণ্ডবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনবাসীর জীবন ও জীবিকা। বড়ই কঠিন সেই পরিস্থিতি। বাঁচার তাগিদে চলছে প্রাণপণ লড়াইয়ের চেষ্টা। ফের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে মরিয়া এখন সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালি, ক্যানিং, গোসাবা, বাসন্তীর বাসিন্দারা। বুধবার তার ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাদাবন জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বেরিয়েছে আমফান। তার সর্বশক্তি দিয়ে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গিয়েছে নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের জীবন। তছনছ করেছে ঘরবাড়ি। বহু প্রাচীন কতশত গাছ টেনে উপড়ে নিয়ে এসেছে মাটির উপর, শিকড় সমেত। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, রাস্তার দু’পাশের বাতিস্তম্ভ।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা জুড়ে আমফান কেড়েছে অন্তত ১৮ টি প্রাণ, মৃত্যু হয়েছে বহু গবাদি পশুর। ব-দ্বীপ অঞ্চলের বহু নদীবাঁধে কোথাও ফাটল ধরিয়ে, কোথাও পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়ে প্রকাশ করেছে তার ধ্বংসলীলা। নদী—সমুদ্রের জল ঢুকেছে গ্রামে। সেই জল সরতেই পড়েছে এবং এখনও পড়ছে শয়ে শয়ে মাটির বাড়ি। নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়েছে জমির উর্বরতা। খেতে পড়ে থাকা ফসলের হয়েছে দফারফা।
২০০৯ সালের আয়লায় নোনা জলে সুন্দরবনে নষ্ট হয়েছিল হেক্টরের পর হেক্টর চাষের জমি। সেই জমির উর্বরতা ফিরতে সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছর। এবারও সেই একই কঠিন পরিস্থিতির শিকার চাষিরা। এভাবে যে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে জীবন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি ওঁরা। একেই দীর্ঘসময়ের লকডাউন আয় কেড়েছে দিন আনা, দিন খাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবন থেকে। কাজ হারিয়ে ভিনরাজ্য থেকে ঘরে ফিরেছিলেন বহু মানুষ। আশা ছিল, এবার গ্রামেই রোজগারের ধান্দায় কিছু একটা করার।
কিন্তু এতবড় এক বিপদ এভাবে ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে ঘূণাক্ষরেও টের পাননি বকখালির অমিয় মন্ডল কিংবা পাথরপ্রতিমার সীতারামপুরের আমিনা বিবি। এতবড় বিপদ যে আসতে পারে আঁচ করতে পারেননি সাগরের সফিকুল কিংবা গোসাবার মোহিতরা। আয়লায় সব হারিয়ে দলে দলে ওঁরা ভিনরাজ্যমুখী হয়েছিলেন জীবনরক্ষার তাগিদে। লকডাউনে কাজ হারিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফের ঘরে ফেরা। গ্রামে ফিরে খুঁজছিল বিকল্প আয়ের কোনও পথ। কিন্তু আমফানের তাণ্ডবের পর দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত ওদের। কারুর পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস চায়ের দোকানটি ধূলিসাৎ। জমির ফসল নষ্ট হওয়ায় বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন তাঁরা। নিজের একচিলতে বাসস্থানটুকু হারিয়ে দিশেহারা অনেকেই। কেউ আবার পরিবারের একমাত্র রোজগেরে প্রিয় মানুষটাকে আমফানের দাপটে হারিয়ে বড়ই অসহায়। করোনা আতঙ্ক ভুলে তাই সকলেই এখন আমফানের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউই জানেনা কবে মিলবে মুক্তির সেই স্বাদ। আদৌ কোনওদিন আর তা মিলবে কিনা, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দিহান ওঁরা। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি তাই বাদাবনের মানুষ। তাঁদের কথায়, ”করোনা নয়, আমফানের ছোবলই শেষ করে দিল তাঁদের জীবন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.