সাবির জামান, মুর্শিদাবাদ: গরম ভাত। তার সঙ্গে একটু ঘি। সঙ্গে আলু সিদ্ধ, কাঁচা লঙ্কা হলে কথা নেই। পাতে এমন কিছু থাকলে কেউ কেউ মাংস ছাড়তেও কুণ্ঠা বোধ করেন না। কিন্তু যে আহ্লাদ নিয়ে আপনি ঘি-ভাত খাচ্ছেন তা কতটা ক্ষতি করছে জানেন? কয়েক মাস আগে নদিয়ার ফুলিয়া থেকে কয়েক কুইন্টাল ভেজাল ঘি মিলেছিল। নানা জেলা থেকে অভিযানে এমন প্রচুর নকল ঘি আটক হচ্ছে। ঘিয়ের ভেজাল কারবারি এবং দুগ্ধজাত এই দ্রব্য নিয়ে সংবাদ প্রতিদিনের এই বিশেষ প্রতিবেদন।
[ফেলো কড়ি নাও ডিগ্রি, ভুয়ো কলেজের ফাঁদ জেলায় জেলায়]
গ্রামগঞ্জের গলি ঘেঁষে গোয়ালা হেঁকে যাচ্ছেন, “ দই নেবে গো দই। ক্ষীর আছে, ছানা আছে, মাখন আছে, ঘি আছে।” বাঁকে করে করে থরে থরে সাজানো সুন্দর সব হাঁড়িতে রয়েছে দুগ্ধজাত দ্রব্য। সেই হাঁকডাকে পাড়ার মোড়ে জটলা করে দাঁড়ায় নানা বয়সী মানুষ। ঘি কিনতে গিয়ে দর কষাকষি করার আগে ঘি রগড়ে কত বার যে পরখ করে দেখে নেন তার ইয়ত্তা নেই। কৌশলটাও ছিল দেখবার মতো। উপুড় করা হাতের কব্জির ঠিক নিচে গোয়ালা একটুখানি ঘি লাগিয়ে দিচ্ছেন আর ওই ঘি অন্য হাতের আঙুল দিয়ে রগড়ে নিচ্ছেন ক্রেতা। ঠিক জহুরির সোনা যাচাই করার মতো ঘি রগড়ে রগড়ে আসল ঘি কি না তা পরোখ করে নেওয়া হত। সেকালে তো ভেজালের কিছু ছিল না বলে দাবি করেন প্রবীণরা। তবে কেন রগড়ে রগড়ে পরখ করা। তার উত্তরে নব্বই ছুঁই ছুঁই বেণীমাধব সাহা, জলিলুদ্দিন সরকার, গোবিন্দ মণ্ডলরা বলেন, “ আরে বাবা তখন ঘি ছিল ষোলো আনা খাঁটি। গোয়ালার বাড়িতে ঘি তৈরি হলে সাত পাড়ার লোক জানতে পারত অমুক গোয়ালার বাড়িতে আজ ঘি টানা হচ্ছে। আসলে পরখ করা হত ঘিতে কতটা জ্বাল দেওয়া হয়েছে। ঠিক মতো পাক হয়েছে কি না তা দেখে নিতে হত। আমরা সে সময় খাঁটি ঘি খেতাম। সে সব তোমরা চোখে দেখবে কি করে, চেখে দেখা তো দূর অস্ত ।”
সেকাল-একাল
ঠিকই বলেছেন প্রবীণ নাগরিকরা। আসল ঘি, ঘিয়ের সেই ফুরফুরে গন্ধ আজ দূর অস্ত। প্লাস্টিক চাল, প্লাস্টিক ডিমের কথা শুনলে অবাক হন বয়সের ভারে বৃদ্ধ মানুষগুলো। সেখানে আবার ভেজালের তালিকায় নতুন নাম ঘি। মুর্শিদাবাদের আনাচে-কানাচে ভরে গিয়েছে ভেজাল ঘিয়ে। এক সময় ছিল দুধে জ্বাল দিয়ে ক্রিম তৈরি করে বানানো হত ঘি। আর ওই ক্রিম থেকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত এলাকায়। সেটাও খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এথন দুধ জ্বাল দেওয়ার পাট চুকে গিয়েছে। তার বদলে শুরু হয়েছে রাসায়নিক কেরামতি। তাতেই ভেজালবাজদের কেল্লা ফতে, আর মানুষ খাচ্ছে বিষ ঘি।
যত রহস্য রাসায়নিকে
বর্তমানে ঘি তৈরিতে আর ক্রিম দরকার পড়ছে না। যৎসামান্য ক্রিমে মেশানো হচ্ছে পাম তেল, ডালডা, বনস্পতি আর তার সঙ্গে পশুর চর্বি। বিহার থেকে ওই ক্রিম আনা হচ্ছে বলা অভিযোগ। তাতেই তৈরি হয়ে ‘টাটকা’ ঘি। আর সুগন্ধির জন্য বাজারি কেমিক্যাল কিংবা রাসায়নিক তো রয়েইছ। এর সঙ্গে বিজ্ঞাপনে বাজিমাৎ করতে পারলেই বাজারের সেরা প্রোডাক্ট হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে এই ভেজাল ঘি। ওই ঘি অর্থাৎ কৃত্তিম ঘি খুব ঠান্ডাতে রাখলেও জমাট বাঁধবে না। মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জ , হরিহরপাড়া, রেজিনগর, শক্তিপুরে এই ভেজাল ঘিয়ের এখন রমরমা। জেলার দুগ্ধ উৎপাদক সংস্থাগুলির দাবি অবিলম্বে প্রশাসন পদক্ষেপ না করলে এর প্রভাব মারাত্মক হবে।
[দেখতে ছানা টাটকা, দুধ কাটাতে ব্যবহার হচ্ছে ‘বিষ’]
যত ভাগীরথী তত ভেজাল
জেলার ভাগীরথী দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় সমিতির “ভাগীরথী” ঘি জেলা তো বটেই বাইরের জেলার মানুষের কাছে বেশ কদর পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ভাগীরথীর মোড়ক নকল করে বাজার পেতে চাইছে নকল কারবারিরা। সমিতির কর্তা ভাস্বর নন্দী বলেন, “আমাদের প্লাস্টিকের কৌটা , নামের অনুকরণ এমন কি কৌটার রঙ পর্যন্ত অবিকল নকল করে বেশ কয়েকটি সংস্থা ভেজাল ঘি বাজারে ছেড়েছে। ওই ঘি খেলে শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হবে।”
[ আলুতে দেদারে মিশছে বিষাক্ত রং, বুঝবেন কীভাবে? ]
সম্প্রতি দুগ্ধজাত ভেজাল রুখতে জেলাগুলিতে উচ্চক্ষমতা সম্পূর্ণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, ভাগীরথী দুগ্ধ সমবায় সমিতির কর্তা, প্রাণী সম্পদ দপ্তরের উপ অধিকর্তাকে নিয়ে ৫ জনের কমিটি গঠিত হয়েছে। জেলার একাধিক দুগ্ধ উৎপাদক সংস্থার দাবি ভেজাল ঘি রুখতে প্রশাসনকে নানা ভাবে জানানো হয়। দেরি হলেও প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছেন এটাই আশা।
কোন পথে ভেজাল
প্রতি মণ দুধে দেড় থেকে ২ কেজি খাঁটি ঘি তৈরি হয়। এক কেজি ঘিয়ের জন্য উৎপাদন খরচ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কিন্তু নকল ঘি তৈরিতে খরচ হয় এর তিন ভাগের এক ভাগ। খাঁটি ঘি তৈরির পর এর যে ডাস্ট (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় চাছি) থাকে, তা দিয়েই তৈরি হয় নকল ঘি। কিছু ব্যবসায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে ওই ডাস্ট সংগ্রহ করেন। পরে তাঁরা ডাস্টের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাটার অয়েল, সয়াবিন, কেমিক্যাল ও লটকন ফলের বীজ গুঁড়ো করে মিশিয়ে তৈরি করেন নকল ঘি।
[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]
ঘি তৈরির কয়েকজন কারিগর জানান, প্রতি কেজি নকল ঘি তৈরি করতে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। আর কেজি প্রতি বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। প্রতিদিন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রচুর পরিমাণ নকল ঘি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণেই ক্রেতাদের বড় অংশ আসল-নকল ধরতে পারেন না। যার ফলে খাঁটি ঘিয়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নকল ঘি ও আসল ঘিয়ের পার্থক্য নির্ণয় করা খুব কঠিন। খাঁটি ঘিয়ের চেয়ে নকল ঘিয়ের রং উজ্জ্বল বর্ণের হয়। গন্ধ নিয়েও আসল-নকল চেনা যেতে পারে। এ ছাড়া নকল ঘি অনেক সময় জমাট বেঁধে থাকে। অতএব সাবধান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.