রাহুল চক্রবর্তী, বহরমপুর: গুরু-শিষ্য। দাদা-ভাই। বহরমপুরের ভোটে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে দুটো শব্দ। শিষ্যকে রাজনীতির তক্তপোশে উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন দাদাই। আবার পলাশি পেরিয়ে কলকাতার রাজপথ পর্যন্ত দাদার ব্যাপ্তিতে শিষ্যই দিয়েছেন পূর্ণ সঙ্গত। কিন্তু রাজনীতির অলি-গলিটা এমনই জটিল যে, দিল্লির মসনদ দখলের লড়াইয়ে এবার তাঁরাই সম্মুখ সমরে। প্রথমজন অধীর চৌধুরি, কংগ্রেস প্রার্থী। অপরজন অপূর্ব সরকার, তৃণমূল প্রার্থী। এক সময়ের অন্তরঙ্গ দু’জনের অনেক কিছুতেই মিল। অমিলও আছে, একটাই।
[ আরও পড়ুন: ভেড়িতে স্নান করতে নেমে তলিয়ে গেল তিন যুবক, চাঞ্চল্য নরেন্দ্রপুরে]
বহরমপুরে জেলা কংগ্রেসের পার্টি অফিসে বসে ভোট নিয়ে কথা হচ্ছিল কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী, ফিরোজা বেগমদের সঙ্গে। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ এলেন তিনি। ব্লু টাউজার্স, হালকা সবুজ রঙের শার্ট ‘ইন’ করে পরা। নীল-ধূসর ফরচুনা গাড়ি থেকে নামতেই উঠল স্লোগান, অধীর চৌধুরি জিন্দাবাদ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন বহরমপুরের ‘রবিন হুড’ অধীর চৌধুরি। তখনই মনে হল, মুর্শিদাবাদের ‘বেতাজ বাদশা’ থেকে এক সময়ের প্রদেশ কংগ্রেসের ‘সর্বাধিনায়ক’কে কখনও পাঞ্জাবি-পায়জামায় দেখা যায়নি। কিন্তু তবুও তিনি ‘জননেতা’। এটা দিয়েই শুরু হল কথাবার্তা। হেসে বললেন, “পায়জামা-পাঞ্জাবি পরলে মনে হয় উলটে পড়ে যাব। তাই পরি না। তবে পুজোর সময় দু-একদিন পরি।” কংগ্রেস নেতা মানেই সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, পায়ে সাদা চটি। এই ‘স্টাইল ফরম্যাটে’ অবশ্য বিশ্বাসী নন অধীর। বললেন, “পার্টিতে কোথাও বলা নেই সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে হবে। কংগ্রেসের কোনও ড্রেস কোড নেই। ওটা বিজেপিতে থাকতে পারে, গেরুয়া।”
[ আরও পড়ুন: বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ, কমিশনের দ্বারস্থ তৃণমূল ]
তাঁর একদা সঙ্গী নেতার মতো পাঞ্জাবির ধার ধারেন না অপূর্ব সরকারও। ডেভিড নামে যিনি পরিচিত। নওদায় এক নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে তৃণমূল প্রার্থী বললেন, “পাঞ্জাবি বাদ, প্যান্ট-শার্টে কমফোর্ট ফিল করি। সারা বছর সেটাই সঙ্গী। শুধু পুষ্পাঞ্জলির দিন পাঞ্জাবি পরি।” গুরু-শিষ্যের মধ্যে অমিল হল, লড়ছেন একে অপরের বিরুদ্ধে। বহরমপুরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, ‘একদা ছায়াসঙ্গী’ দু’জনের লড়াইয়ে জমজমাট এই লোকসভা কেন্দ্র। বহরমপুর আর অধীর চৌধুরি সমার্থক। মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে তিনি যে ‘একমেবদ্বিতীয়ম’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চারবারের সাংসদ। মমতা বিরোধী প্রথম নামটাই তাঁর।
তৃণমূলের ভরা বাজারেও নিজের বহরমপুর হাতছাড়া হতে দেননি। বরং প্রতিবারই জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছেন। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তিনি ছিলেন ‘ফাস্ট বয়’। রাজ্যে রেকর্ড জয়ের মার্জিন ছিল তাঁর, ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৫৬৭।
কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতছাড়া হয়েছে জেলা পরিষদ, পুরসভা, পঞ্চায়েত। তাঁকেও ছেড়েছেন অনুগতরা। যাঁর মধ্যে অন্যতম অপূর্ব সরকার (ডেভিড)। কিন্তু ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অফিসিয়াল ক্যান্ডিডেট অতীশ সিনহার বিরুদ্ধে ডেভিডকে কুঠার চিহ্নে নির্দল প্রার্থী করে জিতিয়ে আনেন অধীরই। তারপর থেকেই অধীর-ডেভিড মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের ‘দুই হাত’। সেই ডেভিড আজ ঘাসফুলে। লড়ছেন তাঁর এক সময়ের ‘বড়দার’ বিরুদ্ধেই। অধীর বললেন, “লোভ-লালসা বেড়ে গিয়েছিল, তাই চলে গিয়েছে।” আর ডেভিড বললেন, “আমি ওঁর (অধীর) কাছ থেকে দীক্ষা নিইনি যে, তিনি আমার গুরু হয়ে যাবেন। ওঁর মুখ আর মুখোশ আলাদা।”
[ আরও পড়ুন: ‘মোদির মুখে ঝামা ঘষে বিজেপি শাসনের অবসান ঘটাবেন মমতা’, হুঁশিয়ারি অভিষেকের ]
বহরমপুর শহর ঘুরে মনে হল, বিজেপি-আরএসপি প্রার্থী এখানে শুধু নামেই আছে। লড়াই আসলে দাদা-ভাইয়ের। মঞ্জুশ্রী মিষ্টির দোকানে ছানাবড়া খেতে খেতে জনৈক ব্যক্তির উক্তি, “অধীরকে হারাতে পারলে মুর্শিদাবাদের নয়া নবাব হবেন ডেভিড।” অধীরের চ্যালেঞ্জ, “বহরমপুরে তৃণমূল প্রার্থীর জামানত জব্দ হবে। আর মুর্শিদাবাদের তিনটি আসনই পাবে কংগ্রেস, লিখে রাখুন।” নির্বাচনী কার্যালয়ে বসেই ডেভিডের পালটা হুঙ্কার, “২০১৯-এ দুটো জিনিস হবে। দেশে বিজেপি ফিনিশ। আর বহরমপুরে কংগ্রেস ভ্যানিশ।” এলাকার লোকজন বলছেন, অধীরের কাছে প্লাস পয়েন্ট হল সিপিএমের সমর্থন। আলিমুদ্দিনের সিদ্ধান্ত, বহরমপুর ও মালদহ দক্ষিণ আসনে বামেরা প্রার্থী দেবে না।
কিন্তু সেই পথে না হেঁটে বহরমপুরে ইদ মহম্মদকে প্রার্থী় করে আরএসপি। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে অধীরকে সমর্থন করছেন সিপিএম নেতারা। কান্দি শহরে (ডেভিডের বিধানসভা ক্ষেত্র) অধীরের সমর্থনে মিছিল করেছে জেলা সিপিএম। বিজেপির প্রার্থীও এখানে বেশ ‘দুর্বল’। কৃষ্ণ জোয়ারদার আর্য বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সল্টলেকের বাড়ির গৃহপ্রবেশে পূজানুষ্ঠানের পূজারি ছিলেন। তার আগে বিজেপির রাজ্য অফিসে কর্মীদের হাত দেখে ভাগ্যগণনা করতেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বলতে এটুকুই! রাজনীতির ‘অ—আ—ক—খ’ না জানা সেই ব্যক্তিকে অধীরের বিরুদ্ধে প্রার্থী করার মধ্যে অনেকেই অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছেন। এমনকী কেন্দ্রের শাসক দলের প্রার্থীর দেওয়াল লিখন, ফ্লেক্স এখানে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
[ আরও পড়ুন: ‘মোদি পাকিস্তানের এজেন্ট’, মহুয়ার প্রচারসভায় তোপ ফিরহাদের ]
তবে সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ তৃণমূলের দিকে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে রেজিনগরে গিয়ে। জিয়ারুল শেখ বললেন, “মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি একটা সময় ছিল। এখন মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের জন্য যে উন্নয়ন করেছেন, তা ভুলে গেলে চলবে না।” ২০০৬ থেকে কান্দি বিধানসভার টানা বিধায়ক থাকার ফলে ডেভিডও এলাকায় পরিচিত মুখ। তবুও বহরমপুরের অনেকের মতেই লড়াই এখানে হাড্ডাহাড্ডি। ২০১৪ আর ’১৯-এর মধ্যে সময় অনেক বদলেছে। ‘কাছের লোক’ চলে গেলেও বহরমপুর হাতে থাকলে অধীর হবেন, ‘হারকার জিতনেওয়ালা বাজিগর।’ আর ঘাসফুল ফুটলে ডেভিড হবেন, ‘খিলাড়িওঁ কি খিলাড়ি।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.