সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়: ছেলে রাজ্য সরকারের উচ্চপদে আসীন। মা খেতে-পরতে পান না। প্রতিবেশীরা খাবার দিলে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয়। নচেৎ নয়। মায়ের এহেন অবস্থাতে ফিরেও তাকায় না ‘গুণধর’ ছেলে। অপমান আর খিদে সইতে না পেরে শেষমেশ প্রশাসনের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেছেন দুর্গাপুরের অসহায় বৃদ্ধা পূর্ণিমা প্রামাণিক।
[ গোষ্ঠী সংঘর্ষে ফের উত্তপ্ত বাসন্তী, গুলিবিদ্ধ হয়ে বালক-সহ মৃত ২ ]
একদিন অবশ্য ভরা সংসার ছিল পূর্ণিমাদেবীর৷রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা এবিএলের কর্মী নিমাই প্রামাণিকের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয় তাঁর। সৎমা হয়েও সেদিন প্রথম পক্ষের একমাত্র ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি পূর্ণিমাদেবী। মাতৃস্নেহে তাঁকে বড় করে তুলতে কোথাও কোনও খামতি রাখেননি, কসুর করেননি। সৎ ছেলে নির্মাল্যর বয়স তখন মাত্র দুই৷ সেই ছেলেকে লালনপালন করে পূর্ণিমাদেবী তাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন।বর্তমানে নির্মাল্যবাবু কলকাতায় রাজ্য সরকারের উচ্চপদে আসীন। বৃদ্ধা বাবা-মাকে ছেড়ে কর্মসূত্রে কলকাতা চলে যাওয়ার পর থেকেই নির্মাল্যবাবু তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন৷ এই পক্ষের দুই মেয়েকে বিয়ে দেন নিমাইবাবু। মেয়েরাও আজ আর শ্বশুরবাড়ির নানা ব্যস্ততায় অসহায় মায়ের দেখাশোনা করতে পারেন না। এদিকে স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চয়ের সমস্তটাই প্রায় ফুরিয়েছে৷ অভিযোগ, বাবার চিকিৎসার ভার নেওয়া তো দূরে থাক, খোঁজখবর পর্যন্ত নেন না অফিসার ছেলে।
[ ফাস্ট ফুডের দোকানের আড়ালে দেদার মদ বিক্রি, গ্রেপ্তার ব্যবসায়ী ]
অসহায় বৃদ্ধা গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে সৎ ছেলের কাছে হাত পেতেও যখন বিফল হন, তখন বাধ্য হয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দুর্গাপুরের মহকুমা শাসকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ সেইসময় সিনিয়র সিটিজেন ট্রাইবুনালের মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তি করে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ারও বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন মহকুমা শাসক। নিমাইবাবু বেঁচে থাকাকালীন তাতেই কোনওমতে চলে যাচ্ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার। কিন্তু সেই সুখও সয়নি পূর্ণিমাদেবীর। ২০১৬ সালে নিমাইবাবুর মৃত্যুর পর আরও অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছেন তিনি৷ ‘গুণবান’ ছেলে বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পারলৌকিক কাজের জন্যে দুর্গাপুর এলেও, যাওয়ার সময় সৎ মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে চলে যান বলেই বৃদ্ধার অভিযোগ৷ তখন থেকেই অসহায় মাকে ‘ভিক্ষা’ দান বন্ধ করেছে ছেলে। নির্মাল্যবাবুর সঙ্গে বারবার ফোনে যোগাযোগ করেও জুটেছে শুধু অপমান।
[ রাজ্যে দুর্ঘটনা কমল তিন হাজার, ধীরে ধীরে কমেছে মৃত্যুর হারও ]
এদিকে উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে আক্রান্ত এই বৃদ্ধা। বাধ্য হয়ে গত ১৬ জানুয়ারি মহকুমা শাসকের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন তিনি। পূর্নিমাদেবীর কথায়,“ হাতে টাকা নেই৷ খাওয়ার জোগান থাকলেও তা তৈরির জোর নেই৷ ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই৷” এদিকে অসহায় বৃদ্ধার স্বেচ্ছামৃত্যুর এই আবেদনের পর প্রশাসনিক মহলেও শোরগোল পড়েছে৷ দুর্গাপুরের মহকুমা শাসক শঙ্খ সাঁতরা জানান,“ এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করা যায় না৷ এই বৃদ্ধাকে আগেই ডাকা হয়েছিল৷ সাময়িকভাবে সমস্যা মিটেছিল৷ ফের একই সমস্যা শুরু হয়েছে৷ আবার সিনিয়র সিটিজেন্স ট্রাইবুনালে বিষয়টি পাঠানো হবে৷”
[ পাঁচিল টপকে জেলে উড়ে আসছে মোবাইল! জলপাইগুড়িতে জালের ঘেরাটোপ ]
এত সবের পরও ‘গুণবান’ অফিসার ছেলে নিরুত্তর৷ নির্মাল্যবাবুকে এই বিষয়ে ফোনে জানতে চাইলে তিনি ট্রাইবুনালেই যা জানানোর জানাবেন বলে ফোন কেটে দেন৷ আপাতত চোখের জলই সম্বল পূর্ণিমাদেবীর। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছেন, “খাবার নেই। ওষুধ নেই। বাঁচব কার জন্য বলতে পারেন! এসডিও যদি স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি না দেন, তাহলে অন্য পথ বেছে নেব।” দুর্গাপুরের এবিএল টাউনশিপের ভাঙা ঘরে একরাশ শূন্যতা নিয়েই পড়ে রয়েছেন পূর্ণিমা প্রামাণিক।পড়শিরা যখন যেমন পারেন সাহায্য করেন। তাঁদের চোখেও একটাও প্রশ্ন, এই কি পাওনা ছিল পূর্ণিমাদেবীর!
ছবি: উদয়ন গুহরায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.