দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: সালটা ২০১০। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। বালিগঞ্জ স্টেশন (Ballygunge Station)। বারুইপুরের দিকে ট্রেন প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। দৌড়ে মহিলা কামরায় ওঠেন মমতা গায়েন। কামরায় ভালো করে দাঁড়াতে পারেননি। হঠাৎ মুখ-সহ শরীরের একাংশে তীব্র জ্বালা। মুহূর্তে ঝলসে যায় শরীরের কিছু অংশ। নষ্ট হয় এক চোখ। অ্যাসিড হামলার পর ঢাকুরিয়া রেল বসতির কাছে ট্রেনের গতি কমতেই লাফিয়ে নেমে পড়ে দুষ্কৃতীরা। ঘটনার পর জীবনের সব কিছু বদলে যায় তাঁর।
বেসরকারি সংস্থার কাজ চলে যায়। হামলার রেশ কাটতে না কাটতে মারা যান তাঁর মা। ছেড়ে যান স্বামী। সব হারিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন মমতাদেবী। কিন্তু এখানেই হয়তো রং বদলায় জীবন! বারুইপুরের এক সংগঠনের হাত ধরে ঘর থেকে বেরোন তিনি। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ছোট্ট ঠেলা গাড়িতে চা-ঘুগনি বিক্রি করছেন বছর পঞ্চাশের মহিলা। তৈরি করছেন রুটিও। রোজ ঠেলা ঠেলে পাড়ার মোড়ে গিয়ে বসেন তিনি। সারা সন্ধে রুটি, ঘুগনি, চা বেচে বাড়ি ফেরেন রাতে।
বারুইপুরের(Baruipur) উকিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা মমতা গায়েন । একসময় তিনি কলকাতায় এক বেসরকারি সংস্থায় রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন। সংসার সামলে রোজ সকালে বারুইপুর থেকে ট্রেনে বালিগঞ্জ যেতেন। সেখান থেকে কর্মস্থলে। কাজ সেরে আবার ট্রেন চেপে ফিরতেন বারুইপুরে। ২০১০ সালে এরকমই একদিন বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে অ্যাসিড হামলা হয় তাঁর উপর। পাশাপাশি আরও ১১ যাত্রী জখম হন সেই ঘটনায়। বসতির বাসিন্দারাই তাঁদের প্রাথমিক শুশ্রুষা করেন। পরে রেলপুলিশ এসে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা চলে মমতার। তবে একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সব কিছু হারিয়ে একা হয়ে পড়েন তিনি। নতুন কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুখে-শরীরের ক্ষতচিহ্ন। কিছুদিন আয়ার কাজ করার চেষ্টা করেন। সেখানেও বাদ সাধে শরীরের পোড়া দাগ। তিনি জানান, লোকজন এড়িয়ে চলতেন। সেভাবে কাজ মিলত না। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নেন মহিলা। কার্যত ঘরবন্দি হয়ে পড়েন। সেই সময় দাদার পরিবারের তরফে একবেলা খাবার মিলত। তা দিয়েই কোনওরকমে দিন গুজরান করতেন তিনি।
জীবনের হাল ছেড়ে দেন তিনি। তবে সহজে হার মানেননি। অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা বারুইপুরের এক সংগঠনের হাত ধরে ঘর থেকে বেরোন তিনি। অ্যাসিড আক্রান্ত আরও মহিলাদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে ফেরে আত্মবিশ্বাস।
শেষ পর্যন্ত বছর খানেক আগে নিজেই কিছু করার ইচ্ছা থেকে তৈরি করে ফেলেন একটি ঠেলা গাড়ি। তা নিয়েই রোজ বিকেলে বাড়ির কাছে পাড়ার মোড়ে এসে বসেন তিনি। চা, বিস্কুট, ঘুগনি বিক্রি করেন। রুটিও তৈরি করেন। পাড়ার অনেকেই রুটি কেনে তাঁর থেকে। চা-ঘুগনি খেতেও ভিড় করেন অনেকে। দু-তিনশো টাকার বিক্রি হয় রোজ। তাতেই কেটে যায় একার সংসার।
মমতাদেবীর কথায়, “এক সময় ভেবেছিলাম সব শেষ। তবে সেখান থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেরটার ব্যবস্থা নিজে করে নিতে পারছি।” অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের তরফে বিমান দত্ত বলেন, “ওঁর এই লড়াই আরও অনেক অ্যাসিড আক্রান্তকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার সাহস জোগাবে। আমরা ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছি ব্যবসাটা আরও বাড়াতে। ইতিমধ্যেই ওঁর ঠেলাগাড়িতে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী দিনে যাতে ওঁ রুটি, তরকার হোম ডেলিভারি করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হবে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.