রমণী বিশ্বাস, তেহট্ট: নারী তো দশভুজা। যে কোনও পরিস্থিতি নিজেদের শক্তি দিয়ে অনায়াসে সামলে নেওয়াতেই নারীত্বের জয়। নদিয়ার তেহট্টের রাখি মণ্ডল সেই নারীশক্তির একটি অংশ। যিনি ভগ্নপ্রায় সংসারকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছেন, স্রেফ নিজের বুদ্ধি আর উদ্যম দিয়ে। আর বাকিটা, সাধারণ নারীজীবনের অসাধারণ কাহিনি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একবার ফিরে দেখা রাখিদেবীর জীবন সংগ্রাম।
স্বামী অসুস্থ বেশ কয়েক বছর ধরেই। কোনও কাজ করতে পারেন না। রাখির সংসারেই থাকেন তাঁর বাবা। বয়সের ভার তাঁকেও কাবু করে ফেলেছে। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে, সংসারে স্বামীর ও বাবার ওষুধ কিনতে খরচ অনেক। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চালাতে আসরে নামতেই হত তেহট্টের পুরনো জিতপুর গ্রামের রাখি মণ্ডলকে। ঋণ নিয়ে প্রথমে একটি টোটো কেনেন রাখিদেবী। তারপর তা চালানো শিখে নেমে পড়েন পথে। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সারাদিন রাখিদেবী থাকেন টোটো চালকের ভূমিকায়, সংসারের খরচ চালানোর জন্য এটাই তাঁর একমাত্র সম্বল। রাখির এই কাজকে সম্মান দিতে তাঁকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা করছে তেহট্ট মহকুমা প্রশাসন।
এখন সংসারের কাজ সামলে, অসুস্থ স্বামী ও বাবার সেবা করে সবদিক বজায় রেখে টোটো চালিয়ে উপার্জন করেন। রাখিদেবীকে দেখে প্রথম দিকে কয়েকজন কটূক্তি শুরু করেন। এই সব অগ্রাহ্য করেই তিনি নিজের কাজে অবিচল থেকেছেন তিনি। এখন সকাল বেলায় পুরাতন জিতপুর বাসস্টপে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে টোটো নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রাখিদেবী। আগে তিনি শুধু স্থানীয় এলাকায় টোটো চালাতেন। এখন তিনি শ্যামনগর, পলাশিপাড়া থেকে অন্য জায়গাতেও টোটো পরিষেবা দেন।
রাখিদেবীর কথায়, “আমার সংসার চালানোর জন্য এই কাজে আসা। আগে স্বামী সুস্থ থাকার সময় আমি সংসার ও ঘরের কাজ সামলাতাম। পরে স্বামী অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় কীভাবে সংসার চলবে, তাই নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। এরপরে আমি ঠিক করলাম কিছু একটা করতে হবে। এই ভেবে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে একটি টোটো কিনলাম। প্রথম দিকে টোটো চালাতে পারতাম না। আস্তে আস্তে টোটো চালাতে শিখলাম। তারপর বাসস্টপে দাঁড়াতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে আমার টোটোতে উঠতে চাইত না কেউ। প্রথমদিকে অনেক কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কিছুদিন পর সকলেই আমার টোটোতে উঠতে শুরু করে।”
তিনি বলেন, “সংসার চালানোর জন্য এই পেশাকে বেছে নিয়েছি। আমি জেদ করেই এই পেশা বেছে নিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল মেয়েরা যদি স্কুটি চালিয়ে রাস্তায় যেতে পারে, তাহলে আমি পেশার জন্য কেন টোটো চালাতে পারবো না।” তাঁরই মতো আরও অনেক মেয়ে লোকলজ্জা, সামাজিক ছুঁৎমার্গ ছেড়ে টোটো চালনাকে পেশা করে নিক, এটাই চান রাখিদেবী। এই বিষয়ে তেহট্টের মহকুমা শাসক অনীশ দাশগুপ্ত বলেন, “রাখিদেবীকে দেখে আরও মহিলারা স্বনির্ভর হলে সরকারের লক্ষ্য পূর্ণ হবে। রাজ্য সরকারের লক্ষ্য মহিলাদের স্বনির্ভর করা। সেইজন্য আমরা ওই মহিলাকে রোল মডেল করে মহিলাদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা করছি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.