গৌতম ব্রহ্ম: নিয়ম মানতে গেলে হয়তো দু’টি প্রাণই ঝরে যেত!
ভোর পাঁচটা পয়ত্রিশ থেকে সাড়ে ছ’টা৷
এক ঘণ্টার নাছোড়বান্দা লড়াই৷ অ্যানিস্থিশিষ্ট নেই৷ দু’টি ফুসফুস জলে ভর্তি৷ হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ৷ ‘একল্যাম্পসিয়া’-য় আক্রান্ত প্রসূতিকে ওটি রুমে নিয়ে যাওয়ারও সময় নেই ৷
‘কার্ডিও পালমোনারি অ্যারেস্ট’ হওয়া সেই প্রসূতিকে লেবার রুমেই
ঝুঁকি নিয়ে ‘ব্লেড’ চালিয়ে ‘পেরিমর্টেম সিজার’ করলেন বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কতর্ব্যরত এক চিকিৎসক৷ বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রায় অলৌকিকভবেই প্রাণের সঞ্চার হল প্রসূতির শরীরে৷ আনন্দে চোখে জল চলে এল লেবার রুমের অন্য প্রসূতিদের৷এদিকে, ডাক্তারের সাহস দেখে স্তম্ভিত চিকিৎসককুল৷ প্রসূতি ও তাঁর সন্তানকে বাঁচাতে না পারলে নিঃসন্দেহে সমালোচনার ঝড় উঠত ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে৷ হয়তো চাকরি চলে যেত৷ নিদেনপক্ষে শো-কজ হত৷ কিংবা প্রসূতির পরিবার দায়ের করত অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা৷ সেই সব কিছুর তোয়াক্কা না করে দু’টি জীবনকে বাঁচাতে অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন ডাক্তার৷ মরা মানুষকে কেটে যেভাবে ময়নাতদন্ত হয়, অনেকটা সেই ধাঁচেই প্রসূতিকে অবশ করার ওষুধ না দিয়েই ‘পেরিমর্টেম সার্জারি’ করলেন চিকিৎসক৷ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন দু’টি জীবন৷ এই জন্যই বোধহয় চিকিৎসকদের ভগবনের দূত বলা হয়৷
প্রসূতির নাম কবিতা মহাপাত্র৷ বাড়ি বাঁকুড়ার ছাতনা থানা এলাকার জামতোড়া কাঠারিয়া গ্রামে৷ গত ৩ মে ভোর পাঁচটা পয়ত্রিশ নাগাদ হঠাৎ কবিতার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়৷ তাঁকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক অবস্থায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়৷ ইমার্জেন্সিতে তখন ডিউটিতে ছিলেন ডা. অনির্বাণ দাশগুপ্ত৷ তিনি জানান, ছ’টা নাগাদ প্রসূতির রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে৷ ১৬০ বাই ১১০৷ ছ’টা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় শ্বাস-প্রশ্বাস৷ স্তব্ধ হয়ে যায় হৃৎপিণ্ড৷ সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার অ্যানেস্থেসিস্টকে ‘কল’ করা হয়৷ সেই সঙ্গে শুরু করা হয় সিপিআর৷ কিন্তু, কিছুতেই হৃৎস্পন্দন চালু করা যাচ্ছিল না৷ অন্য অপারেশন চলায় আটকে গিয়েছিলেন অ্যানিস্থিশিষ্টও৷ বাধ্য হয়ে সাড়ে ছ’টায় লেবার রুমে বসেই অপারেশন করেন অনির্বাণ৷ ব্লেড চালিয়ে সিজার করে কবিতার জঠর থেকে টেনে বের করেন এক কন্যাসন্তানকে৷ পাঠান এসএনসিইউ-তে৷
এরপর শুরু হয় যমে-মানুষে টানাটানি৷ অপারেশন চলাকালীন সিপিআর একবারে জন্যও বন্ধ হয়নি৷ অনির্বাণের সহকারীরা পাম্প করেই যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু হৃৎস্পন্দন চালু হচ্ছিল না৷ পরে অ্যানেস্থেসিস্ট এসে ফুসফুস থেকে জল বের করে ভেণ্টিলেশনে দেন কবিতাকে৷ সোয়া সাতটা নাগাদ ফের পাওয়া যায় নাড়ির স্পন্দন৷ সচল হয় ফুসফুস, হৃৎপিন্ড৷ আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে কবিতার৷ পরের দিনই আইসিইউ থেকে ‘অবজারভেশন ওয়ার্ড’-এ স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে৷ ১০ মে সন্তানকে কোলে নেন কবিতা৷ নিয়ম মেনে হয় ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’-ও৷ কবিতা এখন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবজ্যোতি সাঁতরার অধীনে চিকিৎসাধীন৷ অনির্বাণ জানালেন, “ওই পরিস্থিতিতে অন্য কোনও উপায় ছিল না৷ বিদেশে এমনটা হয়৷ মা মরণাপন্ন হলে ‘পেরিমর্টেম সার্জারি’ করে সন্তানকে বের করে মাকে বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করা হয়৷ আমিও সেই নিয়ম মেনেই কাজ করেছি৷”
বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ ডা. পার্থপ্রতিম প্রধান জানান, মা মারা যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিজার করতে পারলে সন্তানকে বাঁচানো যায়৷ অনির্বাণ প্রসূতির স্বামী মহাদেব মুর্মূর মৌখিক সম্মতি নিয়ে সেটাই করার চেষ্টা করেছেন৷ ঝুঁকি নিয়েছেন৷ এক মিনিট দেরি হলে হয়তো দু’টো প্রাণই ঝরে যেত৷ কিন্তু ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয়৷ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের শরীরেও নতুন করে প্রাণসঞ্চার হল৷ এটা সত্যিই অভাবনীয়৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.