দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: কাকভোরে রেললাইন ধরে টলতে টলতে হাঁটছেন এক প্রৌঢ়। সর্বাঙ্গ রক্তে মাখামাখি। বাঁ হাতে ধরা একটা কাটা হাত। ওঁর নিজেরই ডান হাত, যেটা কি না কনুইয়ের কাছ থেকে বেবাক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে! গত রবিবার, ২৩ অক্টোবর ভোরে মগরা স্টেশনের কাছে দৃশ্যায়িত এ হেন হাড়হিম বাস্তব ঘটনার কথা জানা গেল এক সপ্তাহ বাদে। শনিবার যার বিবরণ শুনে শিউরে উঠছে নাগরিক সমাজ।
ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইকারীকে ধরার জন্য উনি ট্রেন থেকে লাফ দিয়েছিলেন। ততক্ষণে মগরা স্টেশন ছেড়ে লোকাল ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ওঁর ডান হাত কেটে বেরিয়ে যায়, সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। চেতনা ফিরলে বুঝতে পারেন, যেমন করেই হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে। নচেৎ হাত খোয়া যাবে। তাই কাটা হাত আঁকড়ে নিজেই কোনওমতে হেঁটে-দৌড়ে মগরা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে হাজির হন।
কিন্তু অভিযোগ, রেল পুলিশ ওই অবস্থা দেখেও চটজলদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। এবং বিলম্বের খেসারত দিতে হয়েছে চিরজীবনের মতো ডান হাত হারিয়ে। চুঁচুড়া হাসপাতাল ঘুরিয়ে যতক্ষণে ওঁকে কলকাতার এসএসকেএমে পাঠানো হয়, ততক্ষণে কাটা হাত আর জোড়া দেওয়ার অবস্থায় নেই। এসএসকেএমের ডাক্তারবাবুরা শেষমেশ উত্তরপাড়ার তাপস মণ্ডলের কনুইয়ের উপর থেকে ডান হাতের বাকি অংশও বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
পুজোর ছুটিতে উত্তরপাড়ার মাখলা থেকে দলবেঁধে উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়েছিলেন সস্ত্রীক তাপসবাবু। তিন পরিবার মিলিয়ে মোট ৯ জন। ফেরার পথে, ২৩ অক্টোবর ভোরে বর্ধমান স্টেশনে নেমে ডাউন বর্ধমান-হাওড়া লোকালে ওঠেন। অভিযোগ, মগরা স্টেশনে এক দুষ্কৃতী তাপসবাবুর স্ত্রী মিতালিদেবীর হাত থেকে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে ট্রেন থেকে লাফ দেয়। পিছু ধাওয়া করে তাপসবাবুও লাফ দেন, কিন্তু ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। দ্রুতগামী লোকাল থেকে সজোরে আছড়ে পড়ে তাপসবাবু সংজ্ঞা হারান। সম্বিত ফিরলে দেখেন, ডান হাত কেটে বাদ চলে গিয়েছে।
শয্যাগত তাপসবাবু এ দিন জানান, শিয়ালদহমুখী উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে চড়ে ফেরার পথে শিয়ালদহ পর্যন্ত না গিয়ে ওঁরা ভোর তিনটে নাগাদ বর্ধমানে নেমে পড়েছিলেন, যাতে সহজে উত্তরপাড়া ফিরতে পারেন। ‘‘বর্ধমান স্টেশনে চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময়ই দেখেছিলাম, একটা লোক আমাদের আশপাশে ঘুরঘুর করছে, ভাবগতিক মোটেই ভাল নয়।’’- বিধ্বস্ত গলায় বলেন তাপসবাবু, ‘‘সন্দেহটা যে এমন ভাবে সত্যি হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।’’
কী হল তারপর? তাপসবাবু জানাচ্ছেন, লোকটা হাওড়া লোকালের একই কামরায় ওঠে। মগরা স্টেশনে ট্রেন থামতেই স্ত্রীর হাতে ধরা ব্যাগ ছিনিয়ে ট্রেন থেকে লাফ দেয়। ব্যাগে বারো হাজার টাকা ছিল। চোর ধরতে মরিয়া হয়ে তাপসবাবুও ট্রেন থেকে লাফ দেন, বুঝতে পারেননি চাকা গড়াতে শুরু করেছে দ্রুতগতিতে।
‘‘এরপর কিছু মনে নেই। দশ পনেরো মিনিট বাদে জ্ঞান ফিরলে দেখলাম, লাইনের ধারে পড়ে আছি, শরীরময় রক্ত। ডান হাতটা কনুইয়ের উপর থেকে নেই। একটু দূরে কেটে পড়ে রয়েছে।’’
যন্ত্রণাকাতর বিবরণ তাপসবাবুর, ‘‘ডান হাতটা বাঁ হাতে তুলে লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কীভাবে মগরা স্টেশনে গেলাম, নিজেও জানি না।’’ ইতিমধ্যে মিতালিদেবী ট্রেনের চেন টেনেছেন, সঙ্গীদের একজন চেন ধরে ঝুলেও পড়েন। কিন্তু ট্রেন দাঁড়ায়নি বলে অভিযোগ। মিতালিদেবী তখন স্বামীকে ফোন করেন। তাপসবাবু কোনওমতে বাঁ হাতে ফোন বার করে স্ত্রীকে জানান, কী ঘটেছে। বিপর্যস্ত পরিজনেরা পরের স্টেশনে নেমে মগরায় ফিরে আঁতকে ওঠেন। দেখেন, তাপসবাবু কাটা হাত নিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে।
এখানেই রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চরম গাফিলতির অভিযোগ উঠছে। মিতালিদেবীদের অভিযোগ, মগরা জিআরপি তাপসবাবুর ওই অবস্থা দেখেও গা করেনি। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে জিআরপি ওঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখান থেকে চুঁচুড়া হাসপাতালে। তারপর কলকাতার এসএসকেএমে। ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে প্রায় বিকেল, ‘গোল্ডেন আওয়ার’ অতিক্রান্ত। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, ৯ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ায় কাটা হাত জোড়া লাগানো সম্ভব নয়।
অগত্যা তাপসবাবুর ডান হাতের কনুইয়ের উপর থেকে বাকি অংশও অস্ত্রোপচার করে কেটে বাদ দিতে হয়েছে। মিতালিদেবীর আক্ষেপ, জিআরপি সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো ওঁর এই হাল হত না। ‘‘এই অন্যায়ের বিচার চেয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ব, যত দূর যেতে হয় যাব।’’- বলেন মিতালিদেবী। জানান, স্বামী এখন কিছুটা সুস্থ হলেও প্রচণ্ড ট্রমায়, কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না। ঘটনার বিষয়ে মগরা জিআরপি আজ, রবিবার তাঁকে দেখা করতে বলেছে। রেলযাত্রা দিন দিন আতঙ্কের হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ করে মিতালিদেবীর দাবি, ‘‘বর্ধমান স্টেশনের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ আমাকে দেখানো হোক। লোকটাকে ঠিক চিনিয়ে দেব।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.