শুভদীপ রায়নন্দী, শিলিগুড়ি: এতদিন ঘরবাড়ি ছাড়া। ভুলেছেন সংসারের কথাও। কেউ ছেড়ে এসেছেন নিজের দুধের শিশু। কেউ আবার বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা মাকে। মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে মেয়েদের স্মৃতিকে বুকে জড়িয়ে শুধুমাত্র করোনা সংক্রমিত রোগীদের বাঁচাতেই প্রায় এক মাস ধরে দিন রাত এক করেছেন তাঁরা। কেউ এসেছেন কার্শিয়াং, কেউ কালিম্পং আবার কেউ দার্জিলিং কিংবা খড়িবাড়ি থেকে। তাদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক, কেউ নার্স আবার কেউ স্বাস্থ্যকর্মী। অনেকের মনে পড়ে গিয়েছে ২০০১ সালের কালাজ্বরের মতো মহামারির কালাস্মৃতিও।
কিন্তু এইবার যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যেই করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। অনেক রোগীর প্রাণও বাঁচিয়ে বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরিয়েছেন। কিন্তু এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি। করোনা আক্রান্তদের বাড়ি পাঠানোর পর সেই সব সৈনিকদের ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের কথা বা দেখা করতে একমাত্র মুঠো ফোনই ভরসা। চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে সোজা৷ কোয়ারেন্টাইনে। সেখানেই একলা খাওয়াদাওয়া। দিনের পর দিন একইভাবে চলছে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স কিংবা স্বাস্থ্য কর্মীদের। বাড়ি থেকে সব ভয়ে সব ছেড়ে আসার জন্য বললেও এক পাও পিছু হটেননি কেউ। চোখে একটাই স্বপ্ন। কেউ যেন করোনায় প্রাণ না হারায়।
শিলিগুড়ি সংলগ্ন মাটিগাড়ার হিমাচল বিহারের একটি বেসরকারি নার্সিংহোম এখন করোনার রণক্ষেত্র। স্বাস্থ্যদপ্তর সেই নার্সিংহোমটি অধিগ্রহণ করে কোভিড হাসপাতাল করেছে। সেখানেই চিকিৎসা হয়েছিল করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত সেই কালিম্পংয়ের মহিলা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের। মহিলা প্রাণে না বাঁচলেও দুটি দুধের শিশু-সহ পরিবারের দশ জনকে দিনরাত এক করে সেবা শুশ্রূষা করে করোনা মুক্ত করেছিলেন দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকে। এখনও সেখানে করোনা সংক্রমিত হয়ে চারজন ভরতি রয়েছেন। তাঁদেরও চিকিৎসা চলছে। যারা চিকিৎসা করেছিলেন বা করছেন তাঁদের প্রত্যেককেই পালা করে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে দেখা না করার হতাশা গ্রাস করলেও কারওর চোখে আক্ষেপ নেই। কারণ করোনার মতো ভয়াবহ রোগকে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। হাসপাতালে প্রায় শতাধিক চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, স্বাস্থ্যকর্মী কর্মরত রয়েছেন।
কার্শিয়াং মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক হিমাদ্রি শেখর মজুমদার বলেন, “আমার বাড়িতেও তিন বছরের শিশু রয়েছে। আর সংক্রমিত হয়ে আসা যখন দুই শিশু এসেছিল তখন তাদের দেখে আমার ছেলের কথা মনে পড়েছিল। প্রথমে আতঙ্কিত ছিলাম। পরে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।” নার্সিং সুপার সৃজনা রাই বলেন, “অনেক নার্সই মহামারি বা করোনার চিকিৎসার বিষয়ে অবগত ছিল না। দুই নার্স সংক্রমিত হওয়ার পর অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে কেউ ছেড়ে চলে যায়নি। মনোবল বাড়িয়ে প্রত্যেকে চিকিৎসায় সহযোগিতা করেছে। সবার একত্রিত লড়াইয়ের ফলেই দশ জনকে করোনামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।” চিকিৎসক রিচার্ড নার্জিনারি বলেন, “২০০১ সালের কালাজ্বরের মহামারির কথা মনে পরে গিয়েছিল। একইভাবে জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছিল হাসপাতালগুলি।”
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করোনা চিকিৎসায় সবথেকে গুরুদায়িত্ব পালন করেছে। কালিম্পংয়ের পরিবারের করোনা চিকিৎসার দায়িত্বে আটজন চিকিৎসক ছিলেন। তাদের জলসম্পদ বিকাশ দপ্তর, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজ, পাহাড়িয়া ভবন-সহ তিনটি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ১০ জন নার্সকেও কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। আজ, মঙ্গলবার আরও ১৪ জন নার্স ১২ জন চিকিৎসক কোয়ারেন্টাইনে যাবেন। কোয়ারেন্টাইনে দু’বার করে সোয়াব টেস্ট করা হচ্ছে। ওই আট চিকিৎসকের ইতিমধ্যে একবার সোয়াব টেস্ট হয়েছে যার নমুনা নেগেটিভ এসেছে। মঙ্গলবার ফের টেস্ট করার পর রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে বাড়ি যেতে পারবেন তাঁরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.