ছবি: অমিতলাল সিং দেও।
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ঢাক আছে। ঢাকি আছে। আছে ফিরফিরি, ডুগডুগি। আছে স্থানীয় স্তরে তৈরি হওয়া পেপসি, রঙওয়ালা আইসক্রিম। আছে মেলাকে ঘিরে টিনএজারদের প্রেম। আছে মহুলা, হাঁড়িয়া। কিন্তু ভোটের আবহে ভোটটাই নেই। জামবাদের যে মনই নাই ভোটে!
শহর পুরুলিয়া (Purulia) থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে। কেন্দা থানার পুঞ্চা ব্লকের জামবাদ। বর্ধিষ্ণু এই গ্রাম যেন একাধিক কলোনি। ঝাঁ চকচকে রাস্তা দেখে মনে হয় অনেকটা পুর শহরের ওয়ার্ডের মতো। শহুরে পরিষেবা না থাকলেও চেহারা কিন্তু এমনই। সেই জামবাদ এখন বৈশাখী গাজনে আচ্ছন্ন। ফি বছর বৈশাখের ১৩ দিন ধরে এই গাজন বা চড়ক উৎসব হয়। উৎসব একদিনের হলেও এর রেশ থেকে যায় আরও ৪-৫ দিন। এই সাবেক মানভূমে আসন্ন গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব। ষষ্ঠ দফায় ২৫ মে পুরুলিয়া কেন্দ্রে ভোট (2024 Lok Sabha Polls)। কিন্তু জামবাদ মজে বৈশাখী গাজনেই।
তাই প্রায় ৮ হাজার বাসিন্দার এই গ্রামে একটা-দুটো ছাড়া নেই কোনও দেওয়াল লিখন। ভোট প্রচার তো দূর অস্ত। গাজনে মেতে থাকা এই গ্রামে এখনও পা রাখেননি কোনও প্রার্থী। অথচ এই গ্রামে চার চারটি বুথে ভোটারের সংখ্যা প্রায় হাজার পাঁচেক। কিন্তু গাজন উৎসব শেষ হওয়া পর্যন্ত এই গ্রামে পা রাখার কোন সাহস নেই প্রার্থীদের। কারণ কোন রাজনৈতিক দলই এখন এই গ্রামে ভোট প্রচার শুরু করেনি। তাই ভোট নিয়ে কোন উৎসাহ নেই এই জনপদের। গ্রামের মানুষজন জানেনই না ভোটটা কবে? ভোটের কথা জিজ্ঞাসা করলে একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘক্ষণ পর উত্তর আসে, ভোট নাই জানা।
শুক্রবার ভর দুপুর। প্রায় মধ্য গগনে সূর্য। পুরুলিয়ায় তাপমাত্রা পরিমাপ করা কৃষি দপ্তর বলছে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেই প্রখর রৌদ্রে ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে গ্রামের শেষ প্রান্তে শিব মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন। এই ঢাকিদের পেছনে লোহা দিয়ে শরীর ফুঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কমবেশি ৪০০ ভক্তা। সঙ্গে শোভাযাত্রার মত থিকথিকে ভিড়। যা ভোটের আবহে হার মানায় কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল, পদযাত্রাকেও। তাই ঢাকের আওয়াজ শিব মন্দিরের দিকে মিলিয়ে যেতেই ওই গ্রামের জ্যোৎস্না মাহাতো বললেন, “ভোট নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যথা-ই নেই। এখন গ্রাম শুধু বৈশাখী পরবে ডুবে। নির্বাচনের দু-তিনদিন আগে জানতে পারব ভোট কবে। তখন ভোট দিতে যাব। ” ওই গ্রামেরই দুই বৃদ্ধ সুখময় মাহাতো, চিত্ত মাহাতোদের প্রশ্ন করা হয়েছিল ভোট টা কবে? দুই বৃদ্ধ একে ওপরের দিকে চেয়ে বললেন, জ্যৈষ্ঠ মাসের ১২ না ১৩ তারিখ। ঠিক জানা নেই। আসলে গ্রামে তো এখনও কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আসেননি। এমনকি এরিয়া ডমিনেশনও করেনি কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোটের যে কোন রঙ নেই জামবাদে। জনপদ জুড়ে শুধুই আছে গাজনের রঙ।
সংস্কৃতি, মেলায় মিশে থাকা সাবেক মানভূমে এটাই যে স্বাভাবিক। জামবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতে টানা ১০ বার ক্ষমতা ধরে রেখে রাজ্যে যখন নজির তৈরি করেছে সিপিএম। তেমনই এই জনপদ বৈশাখী গাজনে সমগ্র রাজ্যের মধ্যে নজরকাড়া। তাইতো শুক্রবার দূর দূরান্ত থেকে যেমন মানুষজন এই গাজন দেখতে এসেছিলেন। তেমনি এই উৎসবকে ক্যামেরা বন্দিতে জনপদে পা রেখেছিলেন কলকাতা, শহরতলি-সহ বিভিন্ন জেলার বহু চিত্রী। গ্রামের এক উৎসবেই যে হাজার ১৫ মানুষের জমায়েত।
গ্রামের বাসিন্দা, সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্য সোনালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী ভজহরি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গাজন উৎসবটা আমার তত্ত্বাবধানেই হয়ে থাকে। যতক্ষণ না এই মেলা শেষ হয় এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বৈশাখী পরব শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিক প্রচার শুরু করি না। শুক্রবার উৎসব শেষে তার রেশ থেকে যাবে আরও ৪-৫ দিন। তারপর আমরা অর্থাৎ গ্রামের যাঁরা রাজনৈতিক দল করেন তারা প্রচার শুরু করবেন। গ্রামের এটাই রীতি। নীতিও।” জামবাদ অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি বাদল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বৈশাখী গাজন আমাদের গ্রামের একটা আবেগ। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ভোটে নামি না। তা হাতে যতদিন থাকুক না কেন। তাতে যদি প্রচার না হয় না হবে। আসলে এই বৈশাখী পরব পার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামের মানুষ এই ভোটের বিষয়টা ঠিক নিতে পারেন না।”
স্রেফ একটা গ্রামীণ পরবের জন্য গণতন্ত্রের এই বৃহৎ উৎসব থমকে। এমন উদাহরণ বোধ হয় এই বাংলায় কম-ই রয়েছে। গ্রামের শিব মন্দিরের দিকে হেলে পড়ছে সূর্য। মেলায় তখনও থিকথিকে ভিড়। ভোট প্রার্থীরা এই ধরনের মেলা উৎসবকেই জনসংযোগের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু জামবাদের বৈশাখী গাজনের বিধি যে উলটো। উৎসবের রঙে যেন রাজনীতির রঙ মিশে না যায়। সতর্ক থাকে জামবাদ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.