বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: নৃসিংহপুরের চৌধুরিপাড়ার পাশেই গঙ্গা। গঙ্গার বাতাস চৌধুরিপাড়ায় পৌঁছবে, তা তো স্বাভাবিকই। তবে সেই বাতাসে ভেসে বেড়াবে চোলাইয়ের গন্ধ। এমনটা যেন কিছুটা গা সওয়াই হয়ে উঠেছিল ওই এলাকার মানুষের কাছে। কারণ, গঙ্গার কাছাকাছি গজিয়ে উঠেছিল চোলাইয়ের ঠেকগুলি। গঙ্গার ওপারেই কালনাঘাট। চৌধুরিপাড়ার মানুষের অভিযোগ, গঙ্গা পেরিয়ে নৌকা করে ওপার থেকে এপারে এসে পৌঁছত চোলাই। রোজ পালা করেই চোলাই পৌঁছে যেত চোলাইয়ের ঠেকে। সেই ঠেকগুলি রয়েছে ওই এলাকার কয়েকজনের বাড়িতে। রাতে গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই সকাল থেকে শুরু হয়ে যেত মদ বিক্রি। খুলে যেত ঠেকের ঝাঁপ। চন্দন মাহাতো ওরফে গুলবার এমনই এক চোলাই মদের ব্যবসায়ী। অন্য ঠেকগুলি থেকে তার ব্যবসা দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছিল। ড্রাম ড্রাম চোলাই এসে পৌঁছত তার ঠেকে।
রাতে মাত্র কয়েকঘণ্টার হয়তো বিরতি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার খুলে দিত ঠেকের ঝাঁপ। দিনভর চলত চোলাই বিক্রি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, “চন্দন ওরফে গুলবার এলাকার কাউকেই ভয় পেত না। আর পাবেই বা কেন? পুলিশ যে তার হাতের মুঠোয়। চাপে পড়ে কখনও পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেলেও লাভ খুব একটা হত না। দু’দিন পরেই সে আবার ফিরে আসত স্বমহিমায়। ফিরে এসেই চালু করে দিত ব্যবসা। রমরমিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।” ওই এলাকার মানুষের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে তার মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল। নিয়মিত সে নিজেই টাকা পৌঁছে দিত। নয়তো চন্দন মাহাতোর ঠেকে চলে আসত সিভিক ভলান্টিয়াররা। তারা এসে মাসোহারার টাকা নিয়ে যেত। তাই চন্দনের ভয়টা কীসে? রাতে তার ঠেকে গেলেই মিলত মদ। তাই চাহিদা তো কম নয়। বরং দিনের পর দিন তা ক্রমশ বাড়ছিল। এমন একটা ঠেক চালাতে গিয়ে কিছু লোকবল যে রাখতেই হয়। তা ছিল চন্দন মাহাতো ওরফে গুলবারেরও। এই কারণে তার ঠেক বন্ধ করার দুঃসাহস ছিল না কারওরই। পুলিশকে টাকা জুগিয়ে, লোকবলের মাধ্যমে কার্যত বুক ফুলিয়ে চালাচ্ছিল চোলাইয়ের ঠেক।
[বেঙ্গল সাফারি পার্কের চিতাবাঘকে দত্তক, অভিভাবক পেল ‘নয়ন’]
জানা গিয়েছে, চোলাই অবশ্য এখানে তৈরি হত না। কিন্তু গঙ্গা পেরিয়ে ড্রামের পর ড্রাম মদ চৌধুরিপাড়ার ঠেকগুলিতে পৌঁছে যাওয়া এখানে যেন ওপেন সিক্রেট। এই বিষয়টি প্রায় সবারই জানা। তারা নিজের চোখে নৌকা থেকে গুলবার-সহ চোলাইয়ের ঠেকের মালিকদের মাল খালাস করতেও দেখেছেন। বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে ঠেক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গুলবারের ঠেকের মদ খেয়েই ঘটে গেল এত বড় ঘটনা। চলে গেল এতগুলি প্রাণ। চারদিকে শুধুই কান্নার রোল। স্থানীয় মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যাতে না ঘটে, তার জন্য সকালেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় বিশাল পুলিশ বাহিনী। ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজহার এ তৌসিফ, মহকুমা পুলিশ সুপার লাল্টু হালদার। ঘটনাস্থলে পৌঁছন রানাঘাটের মহকুমা শাসক মণীশ বর্মা, শান্তিপুরের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সুমন দেবনাথ-সহ পদস্থ আধিকারিকরা। চন্দন ওরফে গুলবারের ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যাবসার পিছনে যে পরোক্ষে রয়েছে পুলিশি মদত, সে বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার এখনই কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “একজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকিদের খোঁজার চেষ্টা চলছে। আর মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে এলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হবে। এছাড়া, বিশেষজ্ঞ দিয়ে তদন্ত করানো হবে।” গুলবার-সহ অন্যদের চোলাই ঠেকগুলিতে কোথা থেকে আসত চোলাই, সে বিষয়ে শান্তিপুরের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সুমন দেবনাথ বলেছেন, “আমরা যতদূর জেনেছি, গঙ্গার ওপারে বর্ধমানের কোনও কারখানায় তৈরি হওয়া চোলাই পৌঁছত এপারের ঠেকগুলিতে। ওই চোলাই মদে একপ্রকার রাসায়নিক বেশি পড়লে তা বিষ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
ছবি: সুজিত মণ্ডল৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.