সুচিন্তা পালচৌধুরী: রাত পোহালেই বাংলাদেশে ভোট। তবে পড়শি দেশে গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব শুরু হচ্ছে সন্ত্রাসের ছায়ায়। শুধু তাই নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াও পড়েছে প্রশ্নের মুখে। ভোট বয়কট করেছে বিএনপি-জামাতের মতো পাকপন্থী দলগুলো। মানবাধিকার ইস্যু ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর চাপ বাড়াচ্ছে আমেরিকা ও পশ্চিমের দেশগুলো। একইভাবে উদ্বিগ্ন ভারতও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভারতবন্ধু’ মুজিবকন্যার জয় একপ্রকার নিশ্চিত। তাহলে ভবিষ্যতের গর্ভে কী এমন লুকিয়ে আছে যার আঁচ পেয়ে উদ্বিগ্ন দিল্লি?
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক রক্তে গড়া। আক্ষরিক অর্থেই তাই। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে ভারতীয় ফৌজ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে প্রাণ আহুতি দেন তিন হাজার ভারতীয় জওয়ান। সেসমস্তই মুজিবকন্যা জানেন। দিল্লি পাশে না থাকলে পিতৃহন্তা রাজাকররা আবারও মাথাচাড়া দেবে এটাও তাঁর থেকে ভালো কে বোঝে। তাই ভারতকে পাশে নিয়েই চলায় বিশ্বাসী তিনি। ১৯৯৬ সালে যখন হাসিনা প্রথমবার বাংলাদেশের মসনদে বসেন তখন থেকে তিনি ভারতের সঙ্গে এই সখ্য বজায় রেখেছেন। ২০২২ সালে ভারত সফরে এসে তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশ কখনও ভারতকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা অস্বীকার করতে পারি না।” বাংলদেশ যে শুধু ভারতের প্রতিবেশি রাষ্ট্র তা নয় কৌশলগত অংশীদারও। এতে কোনও দ্বিধা নেই যে ফের হাসিনাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চায় ভারত। কিন্তু এই নির্বাচন প্রক্রিয়া কতটা নির্বিঘ্নে মিটবে? হাসিনার ক্ষমতায় ফেরার পথ কতটা প্রশস্ত? এইরকম একাধিক প্রশ্ন উঠছে।
এই মুহূর্তে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামাতের ‘আগুন সন্ত্রাসে’ জ্বলছে বাংলাদেশ। নির্বাচনে কারচুপি ও হিংসার অভিযোগে বিদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ সরকার। বিরোধীদের ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে লাগাতার। হাসিনা সরকারের উপর আর আস্থা নেই জানিয়ে এই সরকার ভেঙে তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু তা না হওয়ায় এইবারের ভোট বয়কট করেছে খালেদা জিয়ার দল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলেও তোপ দেগেছে বিএনপি। আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচন প্রক্রিয়া রুখে দেওয়ার ডাক দিয়েছে তারা। এই লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ-অবরোধ জারি রেখেছে বিএনপি-জামাত-সহ সমমনা দলগুলো। ঘটছে প্রাণহানি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রসংঘ। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারতেরই আরেক ‘বন্ধু’ দেশ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুর নজরে পড়েছে বাংলাদেশ।
এই প্রেক্ষাপটে কিন্তু হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত (India)। কারণ, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলমান প্রধান দেশটি সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে সেই সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার। ফলে নয়াদিল্লির উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, অসম-সহ উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলো। পড়শি দেশে আওয়ামি লিগের বদলে বিরোধী দল বিএনপি ক্ষমতায় এলে উত্তর-পূর্বের রাজ্যেগুলোতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে দিল্লি। বাংলাদেশে পালাবদল হলে আলফা, এনএসসিএনের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো পড়শি দেশে ফের ঘাঁটি জমাবে। ফলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বিশেষ করে কাশ্মীরের মতো পূর্ব দিকেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে টেরর লঞ্চ প্যাড। ঢাকা পাকিস্তানের অঙ্গুলিহেলনে নিয়ন্ত্রিত হলে অসম যে কাশ্মীর হয়ে উঠবে না সেই নিশ্চয়তা নেই। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে জেএমবি, আনসারুল্লা বাংলা টিমের মতো ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলো। ভাষাগত সাদৃশ্য বা ভাষায় মিল থাকার জন্য ওপার বাংলার জঙ্গিরা সহজেই পশ্চিমবঙ্গে গা ঢাকা দিতে পারবে। অন্যদিকে, ঢাকায় মুজিবকন্যার অনুপস্থিতিকে কাজে লাগাবে সুযোগসন্ধানি চিন। তেমনটা হলে চট্টগ্রাম বন্দরে লালফৌজের রণতরীর দেখা মেলা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
নির্বাচনে অংশ না নিয়েও দিল্লির বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছে বিএনপি। বিএনপির (BNP) যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভি আওয়ামি লিগের প্রতি ভারতের সমর্থন নিয়ে বলেছেন, “ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষদের সমর্থন করা। নির্দিষ্ট কোনও দলের পাশে দাঁড়ানো তাদের উচিত নয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে ভারতের কূটনীতিকরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক চায় না।” বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে ভারত, এই অভিযোগের কোনও উত্তর দেয়নি দিল্লি। বরং এর আগে বেশ কয়েকবার ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন, “ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করে এবং সেদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা অন্য কোনও দেশের নীতি নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী হিসাবে, আমরা তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ এবং প্রগতিশীল জাতি গঠনে ঢাকার লক্ষ্যে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভারতবন্ধু’ মুজিবকন্যার জয় একপ্রকার নিশ্চিত। তাহলে ভবিষ্যতের গর্ভে কী এমন লুকিয়ে আছে যার আঁচ পেয়ে উদ্বিগ্ন দিল্লি? উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশে বেড়ে চলা ভারত বিরোধী মনোভাব। ইসলামিক দেশটিতে উগ্র ইসলামের বিশেষ করে সালাফি মতের বাড়বাড়ন্ত উদ্বেগের। ১৯৯৮ সালে এই সালাফি প্রভাবেই জন্ম হয় জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবির। ২০১৫ সালে অভিজিৎ রায়দের মতো মুক্তমনাদের হত্যাই বলে দেয় কোন দিকে এগোচ্ছে পড়শি দেশটি। এখন হাসিনার বয়স প্রায় ৭৬। হয়তো আরও কয়েকবছর বাংলাদেশ শাসন করবেন তিনি। কিন্তু তার পর? এটাই চিন্তা দিল্লির। হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে তা সময়ই বলবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.