সুকুমার সরকার, ঢাকা: ‘আমার বয়স যখন ১৭ বছর, তখন আমরা পূর্ব লন্ডনে চলে আসি। নতুন করে আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল, কিন্তু তারা ছিল রক্ষণশীল, ধর্মাচারী। আমার খুব বেশি পশ্চিমা হওয়াকে তারা বাঁকা চোখে দেখত। আমি তখন এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি নিজেকে বদলে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার উপর যার খুব বেশি প্রভাব ছিল, আমার সেই কাজিন (মেয়ে) বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রবাদে ঝুকেঁ পড়েছিল। তিনি আমাকে খেলাফতের বিষয়ে পাঠ দিতেন। আমি নিজেও অনলাইনে প্রচুর সৌদি ইসলামি ফতোয়া পড়তাম আর ভাবতাম, সত্যের সন্ধান করছি।’
আটের দশকের শুরুর দিকে উত্তর লন্ডনে বাংলাদেশি (Bangladesh) পরিবারে জন্ম নেওয়া তানিয়া জয়া ইংরেজ হিসেবে বড় হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবারের চাপ ছিল ‘ভাল মুসলিম মেয়ে’ হিসেবে বেড়ে ওঠার। সঙ্গত কারণেই তাঁকে পশ্চিমা সমাজে মিশতে দেওয়া হয়নি।একটি ভেঙে পড়া পরিবারে মা-বার প্রতি আস্থাহীনতা ও তা থেকে সৃষ্ট তাঁদের কর্তৃত্বে অনাস্থা নিয়ে বেড়ে উঠা এই তরুণী ইসলামি চরমপন্থায় ঝুকেঁ কীভাবে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এক জিহাদিকে বিয়ে করে সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখান থেকে মুক্ত হয়ে এখন সুস্থ জীবনযাপন করছেন তা ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ানের’ কাছে তুলে ধরেছেন।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তানিয়া বলেন, “২০০৩ সালের মার্চে লন্ডনে ইরাক যুদ্ধবিরোধী একটি মিছিলে আমি অংশ নেই। সেখানে একজন লোক আমাকে এক টুকরো কাজ দেয়। ওই কাগজে একটি মুসলিম ডেটিং ওয়েবসাইটের নাম লেখা ছিল। সেখানেই নবদীক্ষিত মার্কিন মুসলিম জন জর্জেলাসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া বহুভাষী এই তরুণকে দেখে বেশ চৌকস মনে হয়েছিল। তাকে আমার মনে ধরে যায়। লন্ডনে জনের প্রথম সফরেই আমি তাকে বিয়ে করে ফেলি। কারণ, আমি জানতাম এটা ছাড়া বাড়ি ছাড়ার আর কোনো উপায় নেই। কিছুদিন পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই এবং আমাদের একটি ছেলের জন্ম হয়। আমি তখন নেকাব পরা বন্ধ করেছিলাম ও স্বাধীন হয়ে উঠছিলাম, অন্য দিকে জন ঠিক ততোটাই কট্টরপন্থী হয়ে উঠছিল। ২০০৬ সালে ইসরায়েলপন্থী একটি লবিং গ্রুপের ওয়েবসাইট হ্যাক করায় দায়ে জনের তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। আমি তখনও আর্থিকভাবে তার উপর নির্ভরশীল ছিলাম; বুঝতে পারিনি যে আমি নিপীড়নমূলক বিয়েতে আটকে আছি। জন ছাড়া পাওয়ার পর আমরা তিন সন্তানকে নিয়ে মিশরে; পরে ইস্তাম্বুল চলে যাই। সে সিরিয়ায় যাওয়ার কথা তুললেও, আমি বাচ্চাদের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে না নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অনড় ছিলাম।”
নিজের দাম্পত্য জীবনের চাপানউতোর নিয়ে তানিয়া বলেন, “তখন ইস্তাম্বুলে থাকার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। জন আমাকে ও যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারকে বলেছিল, আমরা তুরস্কের আন্তাকিয়ায় চলে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে আমরা সরাসরি চলে গেলাম সিরিয়ার সীমান্তে। মধ্যরাতে আমরা যখন একটি বাস ধরলাম তখনও আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে কী ঘটছে? আমি তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী, বাচ্চাদের নিয়ে একটু বসে ঘুমাতে পেরেই স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভোরের আলো যখন ঘুম ভাঙিয়ে দিল, তখন আমরা সিরিয়ার একটি তল্লাশি চৌকিতে; কোনো ঝামেলা না করতে জন আমাকে সতর্ক করল। আমি তার মাকে কল করে বলি, জন আমাদের কাছে মিথ্যা বলেছে। আমি কান্নাকাটি করলাম; বছরের পর বছর ধরে আমাদের পিছু নিয়ে থাকা এফবিআইয়ের এজেন্টদের সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে বললাম। পরে এফবিআই আমাকে বলেছিল, আমি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলে আমার বিরুদ্ধে জিহাদি সংগঠনে যোগ দেওয়ার অভিযোগ আনা হবে না।”
সিরিয়ায় নারকীয় পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, “সিরিয়ায় কোনও পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল না। কারণ বাড়ির উপরের ট্যাংটি গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। আমি অপুষ্টিতে ভুগছিলাম এবং শিশুরাও। আমি তাদের হারানোর ভয়ে ছিলাম। এফবিআই এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য জন আমাকে দূষত, আর আমি প্রতারণার করায় তার উপর খুব রেগেছিলাম। এই পর্যায়ে আমি যেহেতু মুখ ঢেকে থাকতে রাজি হচ্ছিলাম না, জন আমাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করত। আমাকে ছেড়ে চলে যেতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে তার জেহাদি বন্ধুরা তাকে চাপ দিত। শেষ পর্যন্ত জনের মায়া হল, সে আমাদের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। যদিও সড়কে অবরোধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে আমাদেরকে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। জন আমাদের পরিবহনের জন্য একজন মানবপাচারকারীকে টাকা দিল। স্নাইপারের গুলির মুখে লাফিয়ে ট্রাকে উঠার আগে আমাদের কয়েক মাইল হেঁটে কাঁটাতারে ঘেরা গুহা পার হতে হয়েছিল। আমাদেরকে বাস স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল পাচারকারীর, কিন্তু সেই লোক আমাদের সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় ফেলে রেখে যায়। আমরা চরম দুর্দশায় পড়লাম, পরে দয়ালু এক তুর্কি আমাদের পথ দেখাল। বেঁচে থাকার জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমি চেয়েছিলাম, আমার সন্তানেরা ভাল থাকুক, তাদের জীবন পূর্ণ হোক এবং তারা পৃথিবীকে কিছু দিক। খেলাফত প্রতিষ্ঠায় জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং ইসলামিক স্টেটের শীর্ষস্থানীয় প্রচারক হিসেব পশ্চিমাদের মগজ ধোলাইয়ে আমি ভূমিকা রেখেছি। আমার সঙ্গে তার কখনও দেখা হয়নি এবং পরে জেনেছি, সে সিরিয়ায় আবার বিয়ে করেছে।”
জনের মৃত্যু নিয়ে তানিয়া বলেন, “গত বছর আমি জানতে পারি যে, সে মারা গেছে, সম্ভবত ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার সময়। এখন আমি টেক্সাসে তার বাবা-মার বাড়ির অদূরেই থাকি। আমি জানি, কাছাকাছি থাকা তাদের ও শিশুদের জন্যই ভালো। আমার বর্তমান স্বামী আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নশীল; আমি নিজের মতো স্বাধীনতা ভালবাসি। যুক্তরাজ্যের চরমপন্থাবিরোধী গোষ্ঠী ফেইথ ম্যাটার্সের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। চরমপন্থা থেকে মুক্তির মূল চাবিকাঠি শিক্ষা: ডেটা, তথ্য ও বিজ্ঞান তুলে ধরতে হবে আপনাকে। এই বিষয়টাই আমাকে বদলে দিয়েছে: আমি প্রচূর পড়েছি, নিজেকে শিক্ষিত করেছি। শান্তিতে থাকতে হলে আমাদের মধ্যে সমমূল্যবোধ থাকতে হবে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.