সুকুমার সরকার, ঢাকা: প্রয়াত বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪.৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিশ্বাস ট্যাগ করেন। এই বিখ্যাত শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রয়াত শিক্ষবিদের পুত্র আনন্দ জানান, বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাবার জ্বর আসে। বুকে ব্যাথাও বাড়ে। চিকিৎসকরা তাকে সিসিসি-তে (ক্রিটিকাল কেয়ার সেন্টার)স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। রক্তে সংক্রমণের সঙ্গে পূর্বের নানা জটিলতা নিয়ে গত ২৭ এপ্রিল ৮৩ বছর বয়সী এই অধ্যাপককে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভরতি করা হয়। ৯ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভরতি করা হয়। গত ২৭ এপ্রিল হৃদরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স, প্রোস্টেটের সমস্যা ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানী ঢাকার ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেও একই ধরনের সমস্যার কারণে তাঁকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর গত শনিবার অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়।
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি বসিরহাটে। ভারত ভাগের পর তাঁর পরিবার বাংলাদেশ চলে আসেন। তিনি ছয় দশকেরও বেশি সময় শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আনিসুজ্জামানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আনিসুজ্জামানের শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। এদেশে চলে আসার পর অষ্টম শ্রেণিতে ভরতি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এক বছর পরই পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভরতি হন জগন্নাথ কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তারপর ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ নম্বর। সেই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছিলেন ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন। ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রসঙ্গীত উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- ‘স্মৃতিপটে সিরাজউদ্দীন হোসেন’, ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ’, ‘নারীর কথা’, ‘মধুদা’, ‘ফতোয়া’, ‘ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ’, ‘আইন-শব্দকোষ’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ ও ‘কাল নিরবধি’। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্যের জন্য ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে ভূষিত হয়েছেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.