সুকুমার সরকার, ঢাকা: জামদানি শিল্পের কারিগররা ভাল নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরও দুর্দশা কাটেনি এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরদের। সংশ্লিষ্টরা জানান, সৌন্দর্য, নকশা, বুনন আর ঐতিহ্যে এ দেশের গর্বের পণ্য জামদানি। ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ তালিকাতেও রয়েছে জামদানি। কিন্তু জামদানির ব্র্যান্ডিংয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে যে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল তা নেওয়া হয়নি। এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য নেই স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ব্যাংক ঋণের সুবিধা। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাঁতিরা ঝুঁকছেন অন্য পেশায়। অথচ কারুকার্য ও বাহারি নকশার ফলে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনও জামদানি শাড়ির কদর দেশের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে। আর এটাকেই পুঁজি করে নকল জামদানিতে বাজার ভরে গিয়েছে। দাম কম হওয়ায় ক্রেতারা নকল জামদানি কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
[দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের, জানালেন হাসিনা ]
ঢাকার জামদানি ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ভারতে তৈরি উপ্পাদা জামদানিকে ঢাকাই জামদানি বলে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ কোনও দেশ জামদানি উৎপাদন কিংবা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করতে চাইলে স্বত্ব দিতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট রুবি গজনবী জানান, চোরাই পথে এসে উপ্পাদা জামদানি ‘আসল জামদানি’ বলে বিক্রি হচ্ছে। এই জামদানি গবেষক বলেন, বাজার নকল জামদানিতে ভরে গিয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলের শাড়িতে কিছু বুটিক করেই জামদানি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গজনবী বলেন, যেখানে একটি জামদানি শাড়ির দাম হওয়ার কথা ২০ হাজার টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায়। তাহলে কি এটা আসল জামদানি? তাঁর প্রশ্ন, ‘আমাদের জামদানি পল্লিতে এখন কতজন আসল কারিগর আছেন? দিনদিন কারিগর কমছে। যাঁরা আছেন তাঁদের দক্ষতা আছে, কিন্তু পেটে ভাত নেই। তাঁতিদের পেট না ভরলে তো এ শিল্পের দুর্দশা কাটবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জামদানি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা কিন্তু জাতীয় স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে আমাদের আরও ধাপ পেরতে হবে।’ জামদানি শাড়ি পছন্দ করেন না এমন নারী বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এই চাহিদাকেই পুঁজি করে সস্তার নকল জামদানিতে বাজার ভরে গিয়েছে। সাধারণের চেনার উপায় নেই- কোনটি আসল আর কোনটি নকল জামদানি।
[ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চালু হবে ‘ইন্দো-বাংলা মৈত্রী পাইপলাইন’]
জামদানি শাড়ি কয়েক ধরনের হয়। যেমন সুতি জামদানি, হাফ সিল্ক জামদানি, সিল্ক জামদানি। সম্পূর্ণ হাতের বুননের জামদানিই প্রকৃতপক্ষে আসল জামদানি। হ্যান্ডলুমের জামদানি পরতে যেমন আরামদায়ক, টেকেও অনেক বছর। অন্যদিকে পাওয়ার লুমের জামদানি যেগুলো আসলে কোনও জামদানিই না। জামদানির ডিজাইন নকল করে পলিয়েস্টার সুতোয় বুনে অল্প দামে তা বিক্রি করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার বেইলী রোডের এক জামদানি শাড়ি বিক্রেতা বলেন, আসল-নকল জামদানির পার্থক্য তো দামেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের ক্রেতাদের জামদানির প্রতি দুর্বলতা আছে। আর এটাকেই পুঁজি করে টাঙ্গাইল ও রাজশাহীর শাড়িতে জামদানির নকশা করে তা জামদানি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত থেকেও এ ধরনের শাড়ি প্রচুর আসছে। এগুলো আসলে নকল জামদানি। তবে দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদা রয়েছে। এই পলিয়েস্টার জামদানি দীর্ঘক্ষণ পরে থাকলে অস্বস্তি বোধ হয়। এছাড়া ত্বকের নানা সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে জামদানি শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। জামদানির চাহিদা থাকার পরও ভাল নেই এ শিল্পের কারিগররা। কারণ নকল জামদানিতে বাজার ভরে যাওয়ায় হাতের তৈরি জামদানির আসল কারিগররা মার খাচ্ছেন। হাতে একটি জামদানি তৈরি করতে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগে। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জের আনোয়ার জামদানির অন্যতম স্বত্বাধিকারী জাহাঙ্গির হোসেন জানান, রূপগঞ্জে যেসব জামদানি তৈরি হচ্ছে সেগুলো আসল জামদানি। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় হাতে বোনা আসল জামদানি কম চলে। তিনি বলেন, ক্রেতারা তো বুঝতে চান না। তাঁরা নকল জামদানি কেনেন। কম টাকায় তো জামদানি শাড়ি হবে না। তিনি বলেন, ‘জামদানি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হলেও সরকারের এ শিল্পের প্রতি নজর নেই। আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাই না। নেই কোনো সুযোগ-সুবিধাও। অথচ আমরা এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছি।’ তিনি বলেন, রূপগঞ্জে জামদানি পল্লিতে আর অল্প কয়েকটা তাঁত আছে। দিনদিন কারিগরদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। চাহিদার উপর ভিত্তি করে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন শুধু শাড়ি নয়, পাঞ্জাবি, ফতুয়া-সহ বিভিন্ন পোশাকেও জামদানির নকশা ব্যবহার করা হচ্ছে। রপ্তানি ও বিক্রি বাড়াতে জামদানি শাড়ির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা এবং ঐতিহ্যবাহী এ শাড়ির রং ও নকশার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে গবেষণা করা উচিত। সেইসঙ্গে জামদানির নামে নকল জামদানি বিক্রিও বন্ধ করতে হবে।
[বছরে কতবার প্রজনন করে ইলিশ? রুপোলি ফসলের জীবনরহস্য আবিষ্কার বাংলাদেশের]
জামদানির নামকরণ নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। ‘জামদানি’ শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি ‘জাম’ অর্থ কাপড় এবং ‘দানা’ অর্থ বুটি। সে অর্থে জামদানি বলতে বোঝায় বুটিদানার কাপড়। জামদানি ও মসলিনের প্রচলন প্রায় একই সময়ে শুরু হয়। জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে। বিভিন্ন আরব, চিনা ও ইতালীয় পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনায়। কৌটিল্যের বইতে বঙ্গ ও পুন্ড্র এলাকায় সূক্ষ্মতম বস্ত্রের উল্লেখ আছে। যার মধ্যে ছিল ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসিকা। রপ্তানির সময় কার্পাসিকারই নাম হয় মসলিন। মসলিন ছিল এক রঙের। আর তার মধ্যে কারুকাজ করা কাপড়কে বলা হত জামদানি। মূলত, ঢাকা জেলাতেই মসলিন চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ঢাকার সোনারগাঁও, ধামরাই, রূপগঞ্জ মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মোঘল আমলে জামদানির ব্যাপক প্রসার ঘটে। সম্রাট জাহাঙ্গির জামদানির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতকে লেখা তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করতে গিয়ে মসলিন ও জামদানির কথা বলেছেন। তবে জামদানি শাড়ির সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। এখন রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জের প্রায় ১৫৫টি গ্রামে এই শিল্পের নিবাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.