এশিয়ার সেরা হয়ে দেশে ফিরতেই প্রিয় কোচের সঙ্গে কুলদীপ যাদব। নিজস্ব চিত্র
সব্যসাচী বাগচী: এশিয়া কাপের ফাইনাল (Asia Cup Final 2023) বলে কথা। তাঁর জন্য মেগা ফাইনালের মঞ্চ একেবারে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কোথায় কী! শ্রীলঙ্কার (Sri Lanka) ইনিংস মাত্র ৫০ রানে গুটিয়ে সার্চলাইটের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন মহম্মদ সিরাজ (Mohammed Siraj)। তবে এতে ‘ম্যান অফ দ্য সিরিজ’ হতে সমস্যা হয়নি কুলদীপ যাদবের (Kuldeep Yadav)। ৫ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে এশিয়ার সেরা হলেন কয়েক বছর আগে টিম ইন্ডিয়া (Team India) এবং আইপিএল (IPL) জগতে ব্রাত্য হয়ে যাওয়া এই বাঁহাতি স্পিনার। কিন্তু কোন মন্ত্রে বদলে গেলেন তিনি? কানপুর থেকে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন-কে টেলিফোনে সেটাই জানালেন কুলদীপের ছোটবেলার কোচ কপিল দেব পান্ডে (Kapil Dev Pandey)।
তিনি বলছিলেন, “আমরা সবাই এমনই একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলাম। এটা ওর কাছে সম্মানের লড়াই ছিল। এবার থেকে কুলদীপ শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে যাবে। ২০২১ সাল থেকেই ফর্মে ফিরেছে। এবং সময় যত যাচ্ছে ততই ও এগিয়ে যাচ্ছে। সেটা শুধু জাতীয় দল নয়, আইপিএল-এও দেখা গিয়েছে।” শুধু তাই নয়। বিশ্বকাপের দলগুলোকে কপিলের সতর্কবাণী, “পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ব্যাটাররা এত ভালো স্পিন খেললেও কুলদীপের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের ব্যাটাররা ভয়ে কাঁপবে। এটা এখন থেকেই বলে দিতে পারি। গত ১৭-১৮ বছর ধরে কুলদীপকে চিনি। আমার ছাত্র এখন সেরা ফর্মে আছে। তাই ওকে বাড়তি কিছুই বলার নেই। বিশ্বকাপ কোন পর্যায়ের প্রতিযোগিতা সেটা কুলদীপ জানে। এবং ও বাজিমাত করবেই।”
এশিয়া কাপে বাবর আজমদের বিরুদ্ধে তাঁর খেলার কথাই ছিল না। ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে রোহিত শর্মা (Rohit Sharma) তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘তুই খেলছিস’। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন। কয়েক বছর আগে প্রায় অন্ধকারে চলে গিয়েছিল তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার। সেই কুলদীপের স্পিন ম্যাজিকে বিধ্বস্ত হয়েছিল পাকিস্তান। আর্শাদ আয়ুব (Arshad Ayub) শচীন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar), সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly), ভেঙ্কটেশ প্রসাদের (Venkatesh Prasad) পর চতুর্থ ভারতীয় হিসেবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে ৫০ ওভারের ফরম্যাটে পাঁচ উইকেট নেওয়ার নজির গড়েছিলেন কুলদীপ। দিয়েছিলেন প্রিয় কোচকে গুরুদক্ষিণা!
কপিল দেব ফের যোগ করলেন, “শিক্ষক দিবসের দিন কুলদীপ আমাকে ফোন করে আশীর্বাদ নিয়েছিল। সেদিনই বিশ্বকাপের দল নির্বাচনও হয়। ও বলেছিল, আপনার কী গুরুদক্ষিণা চাই? আমার জবাব ছিল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নিতেই হবে। এবং একেবারে খোলামনে বোলিং করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। এর আগেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গত বিশ্বকাপে খেলেছিল। আমি জানতাম নিজের যোগ্যতা অনুসারে পারফর্ম করলে ওকে বিপক্ষের ব্যাটাররা আটকে রাখতে পারবে না।”
গত দেড়-দুই বছর ধরে কুলদীপের সাফল্য দেখছে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া। তবে বিশ্বের কাছে নিজেকে নতুন ভাবে তুলে ধরার জন্য কুলদীপকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। পায়ের চোট নিয়ে কাটিয়েছেন রাতের পর রাত। দুই চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। তবে থেমে থাকেননি। অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হতেই কোচের সঙ্গে নেটে চলে গিয়েছিলেন। ঘণ্টার পর ঘন্টা চলতো স্পিন বোলিং সাধনা। সেটাই শোনালেন কুলদীপের কোচ, “করোনার সময় ওর জীবন একেবারে বদলে যায়। সেই সময় ওর পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। সুস্থ হওয়ার পর আমি ওর বোলিংয়ে সামান্য রদবদল করেছিলাম। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের কথা মাথায় রেখে কুলদীপ বোলিং শুরু করেছিল। বলের গতি বাড়ানোর উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি রান আটকে দেওয়ার কাজও করেছিলাম। তবে এটাও বলেছিলাম কোনও ডেলিভারির উচ্চতা যেন ছয় ফুটের বেশি না হয়। লুপ-ফ্লাইট এবং ভ্যারিয়েশন যেন বজায় থাকে। সেটা নিয়েও কুলদীপ গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছিল।”
নতুন ভাবে নিজেকে ফিরে পাওয়া কুলদীপ এখন আর শর্ট বল করেন না। ফ্লাইট দেওয়া ভুলেই গিয়েছেন। বরং রান আপ একটু বাড়িয়েছেন। ফলে হারিয়ে যাওয়া গতি আবার ফিরে এসেছে। নিজের বোলিংকে তিনি যে আরও নিখুঁত করেছেন সেটা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদের বিরুদ্ধে ওঁর বোলিং দেখেই বোঝা গিয়েছিল।
ছাত্রের সাফল্য নিয়ে কপিলের ব্যাখ্যা “উপমহাদেশে সেই স্পিনারই সাফল্য পায় যারা ব্যাটারকে ফ্রন্টফুটে খেলায়। কুলদীপ এশিয়া কাপের মতো গত আরও কয়েকটি সিরিজে ধারাবাহিক ভাবে সেটাই বজায় রেখেছে। সেটা করেছে বলেই সাফল্য পাচ্ছে। পাক ও শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদের শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে কুলদীপ ওয়াকিবহাল। নেটে অনেক বছর বল করার সুবাদে কুলদীপ সেটা রপ্ত করেছে। খেয়াল করে দেখবেন ও দু’দলের ব্যাটারদের বাঁ পা টার্গেট করে বল করছিল। এই গুণ কিন্তু কুলদীপ রাতারাতি রপ্ত করেনি। পায়ের অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হতেই ও আমার সঙ্গে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোজ অনুশীলন করে গিয়েছিল।”
২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ছিল কুলদীপের কাছে প্রথম গ্লোবাল ইভেন্ট। সেই কাপ যুদ্ধে ৭ ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। এরমধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঝুলিতে এসেছিল ৩২ রানে ২ উইকেট। বাবর আজমকে কীভাবে বোল্ড করেছিলেন সেটা সবাই জানে। এহেন কুলদীপ কি এবারের কাপ যুদ্ধে ফের নজর কাড়তে পারবেন?
ক্রিকেট যেমন নেয়। ফিরিয়েও দেয়। একটা সময় তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারে নেমে এসেছিল অন্ধকার। সেই কুলদীপই এবার প্রতি ম্যাচে ভারতীয় দলের ‘দীপ’ জ্বালাচ্ছেন। স্বভাবতই কাপ যুদ্ধে তাঁর উপর রোহিত শর্মা-রাহুল দ্রাবিড় জুটি যে ভরসা রাখবে, তা বলাই বাহুল্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.