বিক্রম রায়, কোচবিহার: স্বাধীনতার প্রায় ২ বছর পরও পর্যন্ত কোচবিহার জেলা ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ওই বছরই ভারত সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয় কোচ রাজাদের সঙ্গে। ‘৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারিভাবে ভারতে অংশ হয় আজকের কোচবিহার। তার পর ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক মানচিত্রে কোচবিহার (Cooch Behar) একটি নতুন জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতের অংশ হলেও দীর্ঘ দিন ধরে বাংলা, অসম, বিহারের কিছু অংশ নিয়ে গ্রেটার কোচবিহার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা। অনন্ত মহারাজ আজ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ। দেশের প্রথম সাধরণ নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ছিল কোচবিহার জেলা। তার পর ১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার লোকসভা আসন তৈরি হয়। কোচবিহার লোকসভা হওয়ার পর জাতীয় কংগ্রেসের সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম সাংসদ হন। এর পর থেকে ‘৭৭ সাল থেকে টানা আটবার সাংসদ হন ফরওয়ার্ড ব্লকের অমরেন্দ্রনাথ রায়প্রধান। রাজ্যের পালাবদলের আগে পর্যন্ত এই এলাকায় বামেদের দখলে থেকেছে। রাজ্যের বর্তমান শাসকদল এই লোকসভায় মাত্র একবার আসন জিততে পেরেছে। এখন এই লোকসভা বিজেপির (BJP) হাতে।
জনবিন্যাস
শেষ লোকসভার তথ্য অনুয়াযী, এই লোকসভার কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ লক্ষ ৯ হাজার ৫৯৮ ৷ এর মধ্যে মোট পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৯ লক্ষ ৪০ হাজার ৯৪৮ ৷ মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৮ লক্ষ ৬৮ হাজার ৬৩২। এই লোকসভায় প্রায় ৫২ শতাংশ তফসিলি মানুষ। এই ৫২ শতাংশের মধ্যে আবার ৩৫ শতাংশ রাজবংশী তফসিলি। এছাড়া ২৬ শতাংশের কাছাকাছি মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস।
ইতিহাস
১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র কংগ্রেসের দখলে ছিল। ‘৬২ সালের নির্বাচনে এই লোকসভায় সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক। এর পরেও দুটি লোকসভা অর্থাৎ ‘৭৭ সাল পর্যন্ত সাংসদ পায় কংগ্রেস। ১৯৭৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আসন থাকে ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতের মুঠোয়। এর মাঝে ২০১১ সালে রাজ্যে পালা বদল ঘটে। সেই প্রভাব পরে ২০১৪ সালের লোকসভায়। আসন পায় তৃণমূল। ২০১৬ সালে উপনির্বাচনেও ক্ষমতা ধরে রাখে বর্তমান শাসক দল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আসন পায় বিজেপি।
গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বাংলার এই লোকসভা আসনটি প্রথমের দিকে কংগ্রেসের হাতে থাকলেও প্রায় ৩৭ বছর ফরওয়ার্ড ব্লকের (Forward Bloc) দখলে থাকে। রাজ্যে কংগ্রেসের পর বামেরা ক্ষমতায় আসার থেকে এই লোকসভায় বামপন্থী দল ফরওয়ার্ড ব্লকে অন্য কোনও দলকে জায়গা করতে দেয়নি। অমরেন্দ্রনাথ রায়প্রধান টানা ৮ বার সাংসদ থাকেন তিনি। ২০১৪ সালের তৃণমূলের রেণুকা সিনহা ৫,২৬,৪৯৯ ভোট পান। শতাংশের বিচার করলে ৩৯.৫১ শতাংশ ভোট পান তিনি। এরপর থেকে কোচবিহারের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলাতে থাকে। তৃণমূলের একদা যুব নেতা নিশীথ প্রামাণিক বিজেপিতে যোগদান করার পর এলাকার পরিস্থিতি বদলায়। ২০১৯ সালে বিজেপির টিকিটে জেতেন বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক (Nisith Pramanik)। প্রায় ৫২ হাজার ভোটে জয়ী হন তিনি।
সম্ভাব্য প্রার্থী
বিজেপি নিশীথকে সামনে রেখেই ময়দানে নেমেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে শোনা যাচ্ছে তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়কে দল বাছতে পারে। এছাড়া দৌড়ে রয়েছেন সিতাই বিধানসভার বিধায়ক জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। জেলার রাজনৈতিক মহলের দাবি, যেই প্রার্থী হন না কেন তিনি রাজবংশী সম্প্রদায়ের থেকেই হবেন। অন্যদিকে বাম-কংগ্রেসের প্রার্থী কে বা কারা হবে তা পরিষ্কার নয়। বাম-কংগ্রেসের জোটের উপর নির্ভর করছে তাদের প্রার্থী।
হালফিলের হকিকত
৭টি বিধানসভা আসন নিয়ে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র। গত বিধানসভাতে কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, নাটাবাড়ি,দিনহাটা, সিতাই, শীতলকুচি ও মাথাভাঙা এই ৭টি আসনের মধ্যে ৬টিতেই জয়ী হয়েছে বিজেপি। দিনহাটা কেন্দ্রে উদয়ন গুহকে হারিয়ে প্রথমে নিশীথ প্রামাণিক জয়ী হন। তবে তিনি পদত্যাগ করলে উপনির্বাচন হয়। সেখানে ফের প্রার্থী হয়ে জয়ী হন উদয়ন। ওই বিধানসভা যায় তৃণমূলের পকেটে।
গত বিধানসভায় কোচবিহার লোকসভা ভোটে (Lok Sabha Election) হারার পর অনেকটা ঘর গুছিয়েছে তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচন এই হিসাব দেয়। কোচবিহার জেলার ১২৮টার মধ্যে ১০৬টা গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করে। ২২গ্রাম পঞ্চায়েত যায় বিজেপির দখলে। কোচবিহার লোকসভাওয়ারি হিসাব করলে দেখা যাবে ১০৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। তার মধ্যে ৮৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতেই শাসক দলের। ২০টি বিজেপির। ১২টি পঞ্চায়েত সমিতির সব কটায় রয়েছে শাসক দলের দখলে। ২৬টি জেলা পরিষদের মধ্যে ২৪টি তৃণমূলের দখলে। বাকি ২টি বিজেপির।
সম্ভাবনা
কোচবিহার লোকসভায় ২০১৯-এর পর থেকে এতদিন বিজেপির একছত্র অধিপত্য বজায় রেখেছিল তা বলাই যায়। তবে বিধানসভার উপ-নির্বাচনের পর থেকে ফের হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত ভোটে সব প্রায় আসন দখল করেছে শাসক দল। গতবার কোচবিহারে নিশীথের জেতার পিছনে বড় অবদান ছিল অনন্ত মহারাজের। নিজে রাজ্য়সভার সাংসদ হন। নিশীথও তাঁর ঘনিষ্ঠ। তবে কিছুদিন আগে দলে বিদ্রোহী হয়েছেন অনন্ত। দলের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা ভালো তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি নিশীথকে সর্মথন করবেন কী না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অপর দিকে মুখ্যমন্ত্রীর ইদানিংকালে রাজবংশীদের জন্য উন্নয়ন হাতিয়ার তৃণমূলের। তবে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব শীর্য নেতৃত্বের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। গত বারের ভিত্তিতে লোকসভায় বিজেপির এগিয়ে থাকলেও। এবার লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি এমনটাই মনে করছেন রাজনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.