অর্ণব দাস, বারাকপুর: বঙ্গ রাজনীতির একদা ‘চাণক্য’ মুকুল রায় বয়সের ভারে কিছুটা অসংলগ্ন হয়ে বলে ফেলেছিলেন – ”তৃণমূল মানে ভারতীয় জনতা পার্টি।” তাঁর এই কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের (Barrackpure Lok Sabha) ভোটযুদ্ধে। সেখানকার বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংকে দেখলে তৃণমূল না বিজেপি – এই ভ্রম হওয়া আমজনতার পক্ষে অতি স্বাভাবিক। আর তাঁর প্রতিপক্ষ তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিক। পার্থ-অর্জুনের এই যুদ্ধ মনে করিয়ে দিচ্ছে মহাভারতের যুদ্ধের কথা। ঘটনাচক্রে মুকুল রায়ও এই কেন্দ্রেরই ভোটার। এখন যদিও অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে। দূরে বসেই দেখবেন পার্থ-অর্জুনের লড়াই। গতকালের তৃণমূল, আজকের বিজেপি বনাম বরাবরের তৃণমূলের মধ্যে সংসদে যাওয়ার যুদ্ধ।
কলকাতা লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার বারাকপুর। ব্রিটিশ আমলে সেনা বারাকগুলি গড়ে উঠেছিল গঙ্গা তীরবর্তী এই ছোট্ট জনপদে। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বারাকপুর (Barrackpore)। সিপাহী বিদ্রোহের সলতে পাকানো থেকে জীবন সায়াহ্নে মহাত্মা গান্ধীর কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র, সবই এখানে। এসব ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশিই নির্দিষ্ট ছন্দে আবর্তিত হয়েছে বারাকপুরের নিজস্ব রাজনীতি। এখানকার মানুষজন বরাবর রাজনৈতিকভাবে সচেতন। সবচেয়ে বড় কথা, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে এখানকার রাজনৈতিক আবহ। গত দেড় দশক ধরে সেই হাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে মূলত আইনশৃঙ্খলা, অস্থিতিকর পরিস্থিতিকে ঘিরে। প্রতি নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানকার সঙ্গী। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনও (Lok Sabha Election 2024) তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে প্রায় সমানে সমানে টক্কর দেওয়া শাসক-বিরোধী প্রার্থীদের মধ্যে কে বারাকপুরবাসীর কাছে অধিক নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেন, সেটাই দেখার।
ইতিহাস
১৯৫২ সাল থেকে বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রটি ৮০ সালের পর বিন্যাস বদল বা ডিলিমিটেশনের (Delimitation)ফলে বেশ কিছু কেন্দ্রের সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। প্রথমদিকে কংগ্রেসের দখলে থাকা বারাকপুর ধীরে ধীরে লাল দুর্গে পরিণত হয়। তা দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএমের অন্যতম বড় গড় ছিল। ২০১১ সালে রাজ্যে বামশাসন অবসানের পর রাজনৈতিক রং বদল হলেও এখনও সেখানে সিপিএমের নির্দিষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। বিশেষত শিল্পাঞ্চল হওয়ায় শ্রমিক সংগঠনগুলির ভরসা কাস্তে-হাতুড়ি-তারা।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
বারাকপুর মূলত শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত। একদিকে কটনমিল, জুটমিল, আরেকদিকে ভারী যন্ত্রশিল্প। একসময়ে গঙ্গার তীরবর্তী এই এলাকাগুলির মানুষের ঘুম ভাঙত কারখানা ভোঁ শুনে। দিনভর যন্ত্রপাতির ঘড়ঘড়ানি বন্ধ হতো সূর্য ডুবলে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রমরমা বিগতপ্রায়। কেন্দ্রীয় নীতিই হোক বা অন্য কোনও কারণে একে একে চটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে। বিকল্প শিল্প বা কর্মসংস্থানও গড়ে ওঠেনি সেভাবে। তবে বারাকপুরের মানুষজনের একটা বড় অংশ চাকরি করে। তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে বললে, বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হয়েছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক দিক থেকেও যথেষ্ট নাম রয়েছে এখানকার। নাটক, ইতিহাস, সাহিত্যের চর্চা এখানে যুগ যুগ ধরে প্রবহমান। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘মেঘমল্লার’ এখনও তার সাক্ষী।
জনবিন্যাস
শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এখানকার জনবিন্যাস সম্পূর্ণ মিশ্র। টিটাগড়, ভাটপাড়া এলাকা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত। এছাড়া টিটাগড়ে বহু দক্ষিণ ভারতীয় ও শিখদের বাস। তাঁরা সকলে এখানকার ভোটার। এছাড়া বারাকপুর, নৈহাটি, জগদ্দল, নোয়াপাড়ায় হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর বাস।
বিধানসভা এলাকা
বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭ বিধানসভা কেন্দ্র
অতীতের নির্বাচনী ফলাফল
১৯৫২ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের রামানন্দ দাস জয়ী হন এই কেন্দ্র থেকে। পরেরবার অর্থাৎ ১৯৫৭-এ তৎকালীন প্রজা সোশালিস্ট পার্টির বিমল ঘোষ সাংসদ হন। তার পর থেকে প্রায় একচেটিয়া সিপিএমের গড়ে পরিণত হয় বারাকপুর। ১৯৬২ সালে রেণু চক্রবর্তী থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তড়িৎবরণ তোপদার (Tarit Baran Topdar)বারাকপুরের সাংসদ নির্বাচিত হন। মাঝে অবশ্য দুবার কংগ্রেসের তরফে সৌগত রায় (তখনও তিনি তৃণমূলে যোগ দেননি) ও দেবী ঘোষাল লোকসভার টিকিটে জিতেছিলেন। সকলেই অবশ্য দুঁদে রাজনীতিক। তবে বারাকপুরের রাজনীতিতে সবচেয়ে হেভিওয়েট হিসেবে উচ্চারিত হয় তড়িৎবরণ তোপদারের নাম। দাপট, জনপ্রিয়তায় একসময়ে তিনি ছিলেন পয়লা নম্বরে। এমনকী বামেরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁর সক্রিয়তা কমতে থাকলেও এখনও সভা-মিছিলে তাঁর বক্তব্যের ধার ফিকে হওয়া লাল শিবিরকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তোলার টনিক।
২০০৯ সাল থেকে তৃণমূলের দখলে চলে যায় শিল্পাঞ্চল বারাকপুর। সেবার লোকসভা ভোটে সিপিএম প্রার্থী তড়িৎবরণ তোপদারকে হারিয়ে সাংসদ হন তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী। ২০১৪ সালেও সিপিএমের পরাজয়। ‘বহিরাগত’ সুহাসিনী আলিকে পরাজিত করে ফের সংসদে যান দীনেশ। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে আচমকা শিবির বদল করে ‘বাহুবলী’ অর্জুন সিং বিজেপির প্রার্থী হন। দীনেশ ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ হাজার ভোটে জয়ী হন অর্জুন। বারাকপুর চলে যায় বিজেপির দখলে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে অবশ্য হারানো জমি অনেকটা পুনরুদ্ধার করে তৃণমূল। সাতটির মধ্যে ৬টিতেই ঘাসফুল ফোটে। ভাটপাড়া অর্থাৎ অর্জুন-গড়ে অবশ্য পদ্মই ফুটেছিল।
চব্বিশের লড়াই-সমীকরণ
আর চব্বিশের লড়াইয়ে যুযুধান দুজন – বিজেপির অর্জুন সিং, তৃণমূলের পার্থ ভৌমিক (Partha Bhowmick)। এ প্রসঙ্গে মহাভারতের কথা মনে পড়তে বাধ্য। পার্থ আর অর্জুন একই অঙ্গে যেন একে অপরের প্রতিপক্ষ। আর এখানেই বারাকপুরের ভোটযুদ্ধ ভিন্ন মাত্রায় আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। নৈহাটির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ, ভরসাযোগ্য সৈনিক। একুশের বিধানসভা ভোটে গেরুয়া বলয় থেকে দলকে পুনরুদ্ধারে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। এছাড়া নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত পার্থ ভৌমিক সম্প্রতি জনপ্রিয় ওয়েবসিরিজে অভিনয়ের সূত্রে আরও চেনা মুখ হয়ে উঠেছেন।
অন্যদিকে, অর্জুন সিং (Arjun Singh) বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে একেবারে ঘরের ছেলে। জন্ম-কর্মসূত্রে বারাকপুরই তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র, ‘বাহুবলী’ ইমেজ গড়ে তোলা। অর্জুনকে চেনেন না, এমন মানুষ বোধহয় বারাকপুরে নেই। এখানকার রাজনীতি এখনও বকলমে অর্জুনের নিয়ন্ত্রণে। সে অর্থে এখানকার অশান্তির নেপথ্যেও তাঁকে দায়ী করে থাকে সাধারণ নাগরিকদের একটা বড় অংশ। ফলে ব্যালট যুদ্ধেও পার্থ-অর্জুনের কড়া টক্কর হবেই।
অন্যদিকে, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সংগঠনগুলিতে এখনও বামেদের প্রভাব। বেশিরভাগ CITU সমর্থিত। সেখানে শ্রমিক নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রত্যেকে তাঁকে চেনেন, তিনিও সকলের মুখ মনে রাখেন আলাদাভাবে। ২০১৯ সালে গার্গী সিপিএম প্রার্থী হয়েছিলেন। এবারও সম্ভবত লাল পার্টি তাঁকেই লোকসভা যুদ্ধের ময়দানে নামাতে চলেছে। তবে অন্তিমত বারাকপুরে ‘মহাভারত’-এর লড়াইয়ের নজর থাকছে সকলের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.