রাজ কুমার, আলিপুরদুয়ার: টি-টিম্বার-টুরিজম। 3T ভিত্তি আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র। চা বাগান, পর্যটনের উপর নির্ভরশীল এখানকার অর্থনীতি। মূলত চা বাগানের আদিবাসী অধ্যুষিত বিভিন্ন জনজাতির বাস আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) কেন্দ্রের অন্তর্গত এলাকাগুলিতে। এই লোকসভা কেন্দ্রেই থাকেন টোটো জনজাতির মানুষরা। চা বাগান, পাহাড় ও বনাঞ্চল বেষ্টিত এই লোকসভা কেন্দ্রকে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলা হয়। চা শ্রমিকদের (Tea garden) জনসমর্থন যে রাজনৈতিক দলের দিকে যাবে, তাদের কপালেই আঁকা হবে জয়তিলক। হিন্দু, মুসলিম ছাড়াও খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও তফসিলি জাতি-উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC) – রাজবংশী, রাভা, বোরো সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। আবার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষজনের মধ্যে বাংলাদেশি বেশি। ভোটের ঠিক আগে CAA কার্যকর হওয়ার খবরে কিছুটা আতঙ্কের আবহ। চব্বিশের নির্বাচনী লড়াইয়ে (2024 Lok Sabha Election) আলিপুরদুয়ারে তা একটা নতুন ফ্যাক্টর তো বটেই। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূলের ফলাফল অনেকটা সন্তোষজনক। কিন্তু দিল্লির লড়াইয়ে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি এই চা বলয়। এবার আসা যাক, আলিপুরদুয়ারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে।
জনবিন্যাস:
তফসিলি জাতিভুক্ত (SC) জনতা ৩২%
তফসিলি উপজাতিভুক্ত (ST)জনতা ২৮%
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত জনতা (OBC) ২০% (বেশিরভাগ বাংলাদেশি)
এর মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় ৮০%, মুসলিম ৯%, খ্রিস্টান ৮%, বৌদ্ধ ২%, অন্যান্য ধর্মের ১% মানুষের বসবাস
৪৫% বাঙালি, ২২% আদিবাসী, ১৪% রাজবংশী, ১০% নেপালি, ৫% বিহারি, ২% বোরো, ১% রাভা ও ১% অন্যান্য জাতি এখানকার বাসিন্দা।
৭ বিধানসভা কেন্দ্র
কোচবিহারের তুফানগঞ্জ
জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা
আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রাম, কালচিনি, মাদারিহাট, ফালাকাটা ও আলিপুরদুয়ার
নির্বাচনী ফলাফলের ইতিহাস
১৯৭৭ সালে প্রথম জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র থেকে পৃথক হয়ে আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র তৈরি হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত টানা এই লোকসভা কেন্দ্র বামফ্রন্ট শরিক আরএসপির (RSP) দখলে ছিল।
১৯৭৭-১৯৯১: সাংসদ পীযুষ তিরকে
১৯৯৬-২০০৪: সাংসদ জোয়াকিম বাক্সলা
২০০৯-২০১৪: মনোহর তিরকে
২০১৪-২০১৯: তৃণমূলের দশরথ তিরকে
২০১৯ সালে বিজেপির জন বার্লা জিতে সাংসদ হন। তবে এবার তিনি আর সাংসদ হওয়ার টিকিট পাননি।
কার শক্ত ঘাঁটি, উত্থানই বা কার:
মূলত চা বলয়ে একসময় শক্তঘাঁটি ছিল কোদাল-বেলচা প্রতীকের। রাজ্যে পালাবদলের পর ২০১৪ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যায়। কিন্তু সেসময় বামেদের ভোট ব্যাঙ্ক কিছুটা অব্যাহত ছিল। লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন বিধানসভায় কংগ্রেসের ক্ষমতা অব্যাহত ছিল। কংগ্রসের সেই ভোটব্যাঙ্ক ঘাসফুল শিবিরে যাওয়ার জন্যই ২০১৪ সালে এই লোকসভা তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যায়।
এর পরেই চা বলয়ে গোপনে গোপনে গেরুয়া শিবির তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে ফেলে, যার ফলস্বরূপ উনিশের লোকসভা ভোটে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটে জয় পায় বিজেপি। শুধু তাই নয়, জেলার পাঁচ বিধানসভা-সহ এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে সাত বিধানসভাতেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজেপি। ফলে এই লোকসভা কেন্দ্র বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা – এই মুহূর্তে বিজেপির পরিষদীয় দলনেতা, মাদারিহাটের বিধায়ক। রাজ্য সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে বেশ সক্রিয়। তাঁকেই এবার দিল্লির লড়াইয়ের সেনাপতি করেছে গেরুয়া শিবির।
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকাশ চিক বরাইক – দীর্ঘদিন ধরে চা বলয়ে আন্দোলন করা তরুণ নেতা প্রকাশ। আগেই তাঁর উপর ভরসা করে তৃণমূল রাজ্য়সভায় পাঠিয়েছে। এবার লোকসভা ভোটে নামানো হল প্রকাশকে।
বাম-কংগ্রেসের জোটের সম্ভাবনা রয়েছে এই আসনে। বামফ্রন্টের আরএসপি প্রার্থী হতে পারেন মিলি ওরাও, নইলে কংগ্রেসের প্রার্থী হবেন পাসাং লামা।
হালফিলের হকিকত:
গত বিধানসভা ভোটে এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে সাত বিধানসভা কেন্দ্রেই জয় পায় বিজেপি (BJP)। তবে বিধানসভা নির্বাচনের পর আলিপুরদুয়ার জেলার দুই পুরসভা আলিপুরদুয়ার ও ফালাকাটায় বিজেপি শূন্য পায়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের ১৮ আসনের ১৮ টিতেই জয় পায় তৃণমূল। জেলার ছয় পঞ্চায়েত সমিতির সবকটাই দখলে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। পঞ্চায়েতে ধরাশায়ী হয় বিজেপি। কংগ্রেস ও বামেদের অবস্থা সঙ্গীন।
সম্ভাবনা:
পুর ও পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে এই লোকসভা কেন্দ্রে এগিয়ে তৃণমূল (TMC)। তবে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি আলিপুরদুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র। যদিও লোকসভা ভোটের ঠিক আগে CAA বড় ইস্যু হতে চলেছে। জেলার অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, আশঙ্কার কথা। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির বেশিরভাগ বাংলাদেশি হওয়ায় তাঁরা চিন্তিত। আবার সেখানকার ভূমিপুত্র রাজবংশীরা খুশি। CAA-র মিশ্র প্রভাব রয়েছে। একদিকে, তৃণমূলের CAA বিরোধী প্রচার, অন্যদিকে বিজেপির বার্তা, দেশের স্বার্থেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু করা প্রয়োজন। কোন রাজনৈতিক দলের কথায় নিজেদের সমর্থন ভোটবাক্সে দেবেন এখানকার বাসিন্দারা, গত লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election) নিরিখে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট মেক-আপ দেওয়া শাসকদলের পক্ষেই বা কতটা সম্ভব, সেটাই এখন দেখার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.