সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: হুগলি নদীর ধার বরাবর দক্ষিণ ২৪ পরগনার বন্দর এলাকা ডায়মন্ড হারবার (Diamond Harbour)। রাজ্য রাজনীতির অন্যতম নজরকাড়া কেন্দ্র। লোকসভা ভোটে স্বভাবতই ডায়মন্ড হারবারের লড়াইয় কতটা জমজমাট, তা অনুমেয়। তবে তার পরও রাজনৈতিক মহলে এই কেন্দ্র নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছেই। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের অন্তর্গত বহু এলাকা পঞ্চায়েতের অধীন, কলকাতা পুরসভার আওতায়ও রয়েছে বেশ কিছু অংশ। বেশ কিছু শিল্পাঞ্চল রয়েছে। আর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের সমর্থন যে রাজনৈতিক দলের দিকে যাবে, ভোটযুদ্ধে তার জয়ের পাল্লা ভারী।
এলাকার জনবিন্যাস ও অর্থনীতি
২০১১ সলের শেষ জনগণনা অনুযায়ী, ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে সংখ্যালঘু বাসিন্দা ৫৩ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে থাকে মাত্র ১৩.৫ শতাংশ। বাকি ৮৬.৫ শতাংশের বাস গ্রামাঞ্চলে। ফলে প্রত্যন্ত এলাকায় ভোটের লড়াই সবচেয়ে বেশি। এই লোকসভা কেন্দ্রে বসবাসকারী বেশিরভাগ ভোটার শ্রমিক ও দর্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। অনেকে চটকল এবং সামান্য অংশ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। কৃষিকাজ এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ফলতার শিল্পতালুক আজ প্রায় জনমানবশূন্য। বজবজের চটকলগুলির অবস্থও সঙ্গীন। অনেকগুলি চটকল বন্ধ হয়েছে। যেগুলি চলছে সেগুলিও ধুঁকছে, প্রায় বন্ধের মুখে। অবশ্য বিষ্ণুপুরে ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ছোট ছোট কিছু শিল্প গড়ে উঠেছে। মহেশতলা, মেটিয়াবুরুজের দর্জিশিল্প কিংবা বজবজ, মহেশতলার বাজিশিল্প তবুও কিছুটা ভরসা জোগায় শ্রমিক পরিবারগুলিকে। বেশ কয়েকবার এখানে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ও পুলিশি ধরপাকড়ের জেরে ক্রমেই উৎসাহ হারাচ্ছে বাজিশিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক ও মালিক পরিবার।
বিধানসভা কেন্দ্র
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭ কেন্দ্র –
পুরসভার সংখ্যা চারটি – ডায়মন্ড হারবার, বজবজ, পূজালি ও মহেশতলা পুরসভা। মেটিয়াবুরুজ বিধানসভার কিছুটা অংশ মহেশতলা পুরসভার হলেও বেশিরভাগ এলাকাই কিন্তু কলকাতা পুরনিগমের অধীন। ডায়মন্ড হারবার, বজবজ বিধানসভার বেশ কিছু এলাকা আবার পঞ্চায়েতের অধীন। ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর বিধানসভার সমস্ত এলাকাই পঞ্চায়েতের অধীন।
উন্নয়নের খতিয়ান
লোকসভা কেন্দ্রের একটা বড় অংশের মানুষ অসংগঠিত শ্রমিক। বিগত বছরগুলিতে উন্নয়ন হয়েছে অনেকটাই। প্রতি বিধানসভায় ঢালাই রাস্তা তৈরি হয়েছে। ডোঙ্গারিয়ায় পানীয় জল প্রকল্প, ফলতা-মথুরাপুর জলপ্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফলতায় টেক্সটাইল হাব ও বজবজে বাজি হাব তৈরি হবে। ইতিমধ্যে উদ্বোধন হয়েছে মহেশতলার বাটানগরে নতুন পানীয় জল প্রকল্প। যাতে আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সুবিধা ভোগ করবেন বজবজ, মহেশতলা, পূজালি পুরসভার বাসিন্দারা। চালু হয়েছে সম্প্রীতি উড়ালপুলের নিচের প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার দুই লেনের নতুন রাস্তা। ডায়মন্ড হারবারে আইটিআই কলেজ, মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ নি:সন্দেহে উন্নয়নের প্রতীক।
রাজনৈতিক চিত্র
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রটি ১৯৫২ সালে কংগ্রেসের দখলে ছিল। ১৯৫৭ থেকে কেন্দ্রটি হয়ে উঠে সিপিএমের দুর্ভেদ্য দুর্গ। এই কেন্দ্রে সিপিএমের জ্যোতির্ময় বসু, অমল দত্ত, শমীক লাহিড়ীরা এই কেন্দ্রে প্রত্যেকেই পরপর চারবার করে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই লোকসভা কেন্দ্রে পরপর জেতে সিপিএম। সিপিএমের অমল দত্ত ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এবং সিপিএমের শমীক লাহিড়ী ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চারবার জেতেন। ১৯৯৮ তে শমিক লাহিড়ী হারান তৃণমূলের কাকলি ঘোষ দস্তিদার, ১৯৯৯ তে তৃণমূলের সর্দার আমজাদ আলি এবং ২০০৪ সালে তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়কে হারিয়ে লোকসভার সদস্য হন এই কেন্দ্র থেকে শমীক লাহিড়ী। তার আগে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে সিপিএমের জ্যোতির্ময় বসু ছিলেন লোকসভার সাংসদ। সিপিএমের সেদিনের সেই দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রথম ভেঙে চুরমার করেন তৃণমূল প্রার্থী সোমেন মিত্র, ২০০৯ সালে। তিনি হারান শমীক লাহিড়ীকে।
বিগত নির্বাচনের ফলাফল, বিশ্লেষণ
২০১৪ তে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে জেতেন ৭১ হাজার ২৯৮ ভোটের ব্যবধানে। শতাংশের বিচারে তিনি পান ৩৬.০৯ শতাংশ ভোট, সিপিএম প্রার্থী পান ৩১.০৩ শতাংশ ভোট এবং বিজেপি প্রার্থী পান ১৪.২৬ শতাংশ ভোট। ২০১৯ এ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি প্রার্থীর থেকে জয়ের ব্যবধান বহুগুণ বাড়িয়ে নেন। ২০১৯ এ অভিষেক এই কেন্দ্রে জেতেন তিন লক্ষ কুড়ি হাজার ৫৯৪ ভোটে। সিপিএম প্রার্থী ডাক্তার ফুয়াদ হালিম মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ ভোট পান। বিজেপি প্রার্থী ভোট পান ৩৩.৩৯ শতাংশ ভোট এবং অভিষেক শতাংশের বিচারে ভোট পান ৫৬.১৫ শতাংশ।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল অনুযায়ী
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাতটি আসনই জিতেছে তৃণমূল। প্রথমে এই কেন্দ্র থেকে আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির লড়াই করার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। তৃণমূলের হেভিওয়েট প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর হুঙ্কার ছাড়লেও তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না বলেই শেষ খবর। বিজেপির তরফে প্রার্থী হতে পারেন সাতগাছিয়ার প্রাক্তন বিধায়ক, তথা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া, একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সোনালী গুহ। আর সিপিএমের তরুণ নেতা প্রতীক-উর রহমান মোল্লাকে এই কেন্দ্রের প্রার্থী করতে পারে আলিমুদ্দিন। জল্পনা তেমনই। সেক্ষেত্রে এই কেন্দ্রে ত্রিমুখী লড়াই হতে চলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, বিজেপির সংগঠন এই সাতটি বিধানসভার কোথাও তেমন মজবুত নয়। মাত্র কয়েকটি পকেটে বিজেপির অস্তিত্ব রয়েছে। বামেদের অবস্থাও তথৈবচ। ফলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই এই কেন্দ্রের জয়ী হিসেবে এগিয়ে রাখছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালে অভিষেক ৩ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে। এবার সেই ব্যবধান ৪ লক্ষ করার টার্গেট নিয়েছেন তিনি। তবে সবটাই নির্ভর করছে জনতা জনার্দনের কাজের উপর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.