এলমাগোন্ডা যাওয়ার একটাই কারণ। গ্রামের মানুষের কাছে প্রথমবার ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা শোনা। এই রাস্তাতেই পড়ে কোন্ডা। বছরখানেক আগে সেখানে সিআরপিএফের উপর বিরাট হামলা চালিয়েছিল মাওবাদীরা। সেই কোন্ডাতেও গত বছর ভোট হয়েছে। এ-বছর ভোট দেবে সেখানকার মানুষ? লিখছেন স্যমন্তক ঘোষ।
সন্ধে সাতটা। সুকমার পুলিশ সুপারের গাড়ি কি বুলেট প্রুফ? গজল্লা করতে করতেই ঢোকা গেল পুরনো এসপি অফিসে। দোতলার বাঁদিকে লম্বাটে ঘর। দরজার বাইরে বড়-বড় করে লেখা, ‘ওয়ার রুম। প্রবেশ নিষেধ।’ ডানদিকে পুলিশ সুপারের চেম্বার। দেওয়ালজোড়া বিশাল এক মানচিত্র। সারা বস্তার ধরা আছে তাতে। মানচিত্রের মাঝ-বরাবর ইন্দ্রাবতী নদী।
ইন্দ্রাবতী। এক আশ্চর্য প্রেম। এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ। দণ্ডকারণ্যের এই অঞ্চলে আরও দু’টি নদীর নাম পাওয়া যায়। ইন্দ্র আর উদন্তী। পুরাণের গল্প বলে, চন্দন আর চঁাপা ফুলের গন্ধ একসময় ম-ম করত এই দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে। মায়াময়, মোহময় সেই জঙ্গলের টানে স্বর্গ থেকে নেমে আসেন ইন্দ্র আর ইন্দ্রাণী। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছে উদন্তী নামের এক অপরূপ সুন্দরী নারীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন ইন্দ্র। প্রেমকহানি পৌঁছয় ইন্দ্রাণীর কানে। ব্যস, উদন্তী আর ইন্দ্রের মাঝখানে সীমান্ত তৈরি করে দেন তিনি! সেই থেকে বয়েই চলেছে ইন্দ্রাবতী। তার দুই ধারে সমান্তরালে থেকে গিয়েছে ইন্দ্র আর উদন্তী নদী। আর কখনওই দেখা হয়নি তাদের। মেলামেশাও হয়নি।
সীমান্তই বটে। ইন্দ্রাবতীর একধারে রাষ্ট্র, অন্য পারে মাওবাদী মুক্তাঞ্চল। একধারে পুলিশের বন্দুক, অন্য পারে ‘জনতানা সরকার’-এর চোখরাঙানি। রাস্তায় মাইন। গাছে-গাছে পোস্টার। তাতে লেখা, পুলিশের চর হিসাবে কাজ করলে, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
জঙ্গল পেরিয়ে গ্রাম। গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গল। জঙ্গল পেরিয়ে ‘অবুঝমাড়’ (বাংলায় যাকে বলে, নিশ্চিন্দিপুর)। তারপর আবার জঙ্গল। জঙ্গল পেরিয়ে মাওবাদী ক্যাম্প। অবুঝমাড়ে বিশাল শহিদ বেদি। বেদি ঘিরে বিছিয়ে রাখা মাইন। পুলিশ যখন এসব এলাকায় ঢোকে, তাদের প্রথম টার্গেট হয় ওই বেদিগুলি। শহিদ বেদি মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অর্থ, মাওবাদীদের পরাস্ত করে রাষ্ট্র শাসন কায়েম করেছে ওই এলাকায়। আর সেই কারণেই মাওবাদীরা শহিদ বেদি ঘিরে মাইন বিছিয়ে রাখে। পুলিশ বেদি ভাঙার চেষ্টা করলেই বিস্ফোরণ।
পুলিশ সুপারের ঘরে মানচিত্রের মাঝখান দিয়ে বইছে ইন্দ্রাবতী। তার পশ্চিমে সুকমা জেলার পাহাড় ঘেঁষে লম্বা রাস্তা। আর সেই রাস্তা বরাবর একের-পর-এক পতাকাচিহ্ন। এক-একটি পতাকা এক-একটি সিআরপিএফ ক্যাম্প। এক-একটি ক্যাম্প মানে এক-একটি বিজয়। এক-একটি বিজয় মানে এক-একটি ভোট। ২০২৩ সালে ছত্তিশগড়ের (Chhattisgarh) বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম ভোট দিয়েছে এলমাগোন্ডা গ্রাম। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর গ্রামে প্রথম ভোটের বুথ হয়েছে স্কুল ভবন। সুকমা শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার রাস্তা এই এলমাগোন্ডা। বছর কয়েক আগেও এত চওড়া রাস্তা ছিল না এদিকে। জঙ্গলের রাস্তায় চলাফেরা করতে হলে ‘ভিতর’-এর অনুমতি নিতে হত। রাস্তার ধারে ছোট-ছোট পাতার ছাউনি থেকে নিভৃতে লক্ষ রাখত অতন্দ্র চোখ, বন্দুকের নল।
সেই দিন গিয়েছে। গত কয়েক বছরে পুলিশ ক্রমশ ভিতরে ঢুকেছে। তৈরি হয়েছে রাস্তা। আর রাস্তার ধারে-ধারে সিআরপিএফ ক্যাম্প। ক্ষমতার চেহারা বদলেছে, বদলায়নি সার্ভেইলেন্সের ধরণ। পুলিশ সুপার এই রাস্তার উপর দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে দেখাচ্ছেন, কীভাবে মাওবাদীদের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষের পর একটি-একটি করে ক্যাম্প বসানো হয়েছে। পিছু হঠে এখন পাহাড়ের কোন এলাকায় মাওবাদীদের অবস্থান, নকশাল যোদ্ধাদের কোন পল্টন কোন এলাকায় কীভাবে টহল দিচ্ছে, কোন পল্টনের নেতৃত্বে কোন কম্যান্ডার। গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাব্য অঞ্চলের উপর হাতের পাঞ্জা পাতলেন এসপি।
পাঞ্জা-র একপাশে ইন্দ্রবতী। একপাশে রাষ্ট্রক্ষমতা। ক্ষমতা আর প্রতি-ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝখানে ওই রাস্তার ধারেই সম্প্রতি বলি হয়েছে এক ছ’-মাসের শিশু। বাড়ির দাওয়ায় বসে ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা। তারই মধ্যে শুরু হয় ফায়ারিং। পাঞ্জা-র দু’-দিক থেকেই। পাতার ঘর রোদে ছায়া দেয়, বৃষ্টির জল আটকায়। কিন্তু গুলির ঢাল হতে পারে না। ছেলে কোলে না-থাকলে গুলি মায়ের বুকে বিঁধত। কেন বিঁধল না, এই আফশোসে মা সেই থেকে বাক্রুদ্ধ।
কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আরেকটি শিশুর। খেলতে গিয়ে এই রাস্তার ধারেই পাঞ্জা-র ওপারে মাইনে পা দিয়ে ফেলেছিল সে। শোনা যায়, অপরাধ-ক্ষালন করতে মাওবাদীরাই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এলমাগোন্ডার রাস্তায় যেতে গেলে এখন দু’-পক্ষেরই অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি নিতেই পুলিশের ঘরে সাংবাদিক। এলাকা চেনাচ্ছেন পুলিশ। বলছেন, সাদা ইনোভা বা স্করপিও না নেওয়াই ভাল। প্রশাসনের গাড়ি ভেবে জঙ্গলের দিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কা আছে।
স্থানীয় সাংবাদিক এবং দীর্ঘ দিনের বন্ধু রৌনক চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভয় নেই, ভিতরেও খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ফলে আক্রমণের আশঙ্কা নেই। আমার চিত্র সাংবাদিক রাউফ বলে দিয়েছে, রাস্তায় চ্যানেলের লোগো লাগানো ‘বুম’ (মাইক) জানালার বাইরে বের করে রাখবে সে। যাতে দূর থেকে, জঙ্গলের ভিতর থেকে যে অদৃশ্য চোখ আমাদের ফলো করবে, তারা যেন সহজেই বুঝতে পারে আমাদের পরিচয়।
এত কাণ্ড করে এলমাগোন্ডা যাওয়ার একটাই কারণ! গ্রামের মানুষের কাছে প্রথমবার ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা শোনা। এই রাস্তাতেই প্রথম পড়বে কোন্ডা। বছরখানেক আগে সেখানেই সিআরপিএফ-এর উপর বিরাট হামলা চালিয়েছিল মাওবাদী গেরিলা-বাহিনী। বহু জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। সেই কোন্ডাতেও গত বছর ভোট হয়েছে। এ-বছরও ভোট দেবেন তঁারা?
এলমাগোন্ডায় পাকা বাড়ি বলতে কেবল একটি স্কুল। দীর্ঘ দিন যা বন্ধ ছিল। ২০১৯ সালে নতুন করে খুলেছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, স্কুল হয়েছে, তা-ই ভোট হয়েছে। নইলে ইভিএম রাখার মতো কোনও বাড়িই তো ছিল না গ্রামে। কংক্রিট বলতে আর যা ছিল, রাস্তার ধারে যুদ্ধের ধ্বাংসাবশেষ হয়ে পড়ে আছে সেই শহিদ বেদি। অর্থাৎ, জনতানার সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে রাষ্ট্রের হাতে। অবুঝমাড়ের জনতানা-শাসিত এলাকার মতো এই অঞ্চলের মানুষ মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে রাখেন না। প্রথমবার ভোট দিয়ে তারা খুশি। আঙুলে ছাপ, বোতামে চাপ– বেশ একটা উৎসব। উৎসবের আগে বৈঠক হয়েছিল। গ্রামের মানুষকে জঙ্গলে ডেকে পাঠিয়েছিল এলাকার মাওবাদী কম্যান্ডার। বহু আলোচনার পর স্থির হয়েছিল, গ্রামের মানুষ ভোট দিলে জঙ্গল তা অপরাধ হিসাবে দেখবে না। শাস্তি হবে না। এদিকে, সিআরপিএফ ক্যাম্পে গিয়েও মানুষকে কথা দিয়ে আসতে হয়েছিল যে, তারা ভোট দেবে।
একটি ভোটের জন্য কয়েক দফায় আলোচনা হয়েছে। এবারের ভোটের আগে আবার শুরু হয়েছে সেই আলোচনা। দুই তরফেই। ইন্দ্রাবতীর এপারেও, ওপারেও। তবে এবারের আলোচনায় উঠে আসছে আরও কিছু কথা। ২০২৩ সালে যে রাজনীতিবিদরা ভোট ভিক্ষা করতে এসে বলে গেলেন, কতটা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওই জায়গায় পৌঁছেছেন তঁারা– শোনালেন সেই গ্রামবাসীদের, যঁারা প্রতিদিন সেখানে বসবাস করেন– ভোটের পর আর তো দেখা গেল না তঁাদের? এটাই কি গণতন্ত্রের নিয়ম? সাংবাদিকের কাছে যখন এই প্রশ্ন এসে পৌঁছল, বেলা তখন গড়িয়েছে বিকেলের পথে। দূরে গাছের ছায়ায় শুয়োর পোড়াচ্ছেন কয়েকজন। হঁাড়িয়ায় বুঁদ নেশা হাতে গাছের ডাল নিয়ে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে রত। একটি ট্র্যাক্টরে করে বেশ কিছু লোক জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকে গেল। ভূতের মতো জনৈক আচমকাই এসে জানতে চাইলেন আমরা রাস্তার কনট্রাক্টর কি না। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে কয়েকটি বাচ্চা বটের ঝুরি ধরে পাকিয়ে পাকিয়ে ঝুলছে। মাথার উপর একপাক খেয়ে জলপাই হেলিকপ্টার শহরের দিকে চলে গেল। রৌনক জানাল, ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।
গণতন্ত্র-সংক্রান্ত প্রশ্নটির উত্তর না-দিয়েই উঠে পড়তে হল গাড়িতে। গণতন্ত্রই শিখিয়েছে, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় বা দায়িত্ব নিতে নেই। কিছু প্রশ্ন ফেলে রাখতে হয় জনান্তিতে, অবুঝমাড়ের গ্রামে। গণতন্ত্র আর ওই প্রশ্নে মাঝখানে সীমান্ত টেনে দিয়েছে ইন্দ্রাবতীর জল। ইন্দ্র আর উদন্তীর মতোই তারা যেন ইন্দ্রাবতীর দুইধারে দুই সমান্তরাল।
গ্রাম থেকে বেরনোর মুখে আচমকা ব্রেক কষলেন চালক। হুমড়ি খেয়ে ড্যাশবোর্ডে পড়ার সময় উইন্ড স্ক্রিনে চোখ গেল। রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে পাথর সাজিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আসার সময় এমনটা ছিল না। তবে পাথর এমনভাবেই সাজানো হয়েছে, যাতে অন্য প্রান্ত দিয়ে কষ্ট করে হলেও গাড়ি বের করে নেওয়া যায়। রৌনক হাসছে। বলছে, গ্রামে এতক্ষণ ধরে গণতন্ত্র আর ভোট (Lok Sabha Election 2024) নিয়ে কথা হয়েছে। এ হল তার পালটা জবাব। পাথুরে বিবৃতি। জঙ্গল আর রাষ্ট্রক্ষমতার মাঝখানে এভাবেই সীমান্ত তৈরি করে রেখেছে এক পাথুরে ইন্দ্রাবতী।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.